বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে বন্ধু রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। এক একটি পরিস্থিতি একেকটি সঙ্কটে পরিণত হতে পারে, এবং সেই পরিস্থিতি নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। একটি গল্প মনে পড়ে, যেখানে এক এক করে বনজ গাছগুলো কাটা হচ্ছিলো। বাকি গাছেরা ভাবছিলো, "কুড়াল তো আমাদেরই লোক। দেখো না, তার হাতলটা আমাদের তৈরি।" কিন্তু যখন সর্বশেষ গাছটি কাটা হলো, তখন সবাই বুঝতে পারলো, কুড়াল আসলে গাছেদের কেউ ছিলো না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কও তেমনই এক পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের একটি নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। ভারত কর্তৃক ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা শুধু একটি বিপদ নয়, বরং কিছু সম্ভাবনাও নিয়ে আসতে পারে। তবে এই সংকটকে বাংলাদেশ যদি সঠিক কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে পারে, তাহলে এটি ভবিষ্যতে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য একটি শক্তিশালী সুযোগ সামনে।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন। মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরাসরি রপ্তানি ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারবে। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে ২০ ফুট এককের কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে প্রায় পৌনে দুই লাখ এবং কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ টন (সূত্র: সমকাল, ২০২৫)। এতে স্পষ্ট যে, যদি বাংলাদেশ তার বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে পারে, তবে রপ্তানি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব হবে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বাস্তবায়ন হলে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। ভারত, নেপাল এবং ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হলে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ছাড়াই বাণিজ্য বৃদ্ধি সম্ভব হবে। নতুন আন্তর্জাতিক বাজারগুলোতে প্রবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারবে।
অতএব, ভারতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের জন্য কিছু বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত, গার্মেন্টস শিল্পে, যেখানে লজিস্টিকস ব্যবস্থার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি, এমন পরিস্থিতি আরও বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪% ছিল (সূত্র: বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা)। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হওয়ায়, পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে দেরি হবে, যা বাংলাদেশের বাজারের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এছাড়া, নতুন রুটে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশকে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে, যা একটি বড় আর্থিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এই সংকট শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের জন্যও আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হলে, ভারতীয় বন্দরের রাজস্ব আয় কমে যাবে। বাংলাদেশকে বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হলে, পরিবহন খরচও বৃদ্ধি পাবে, যা ভারতের জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।
এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী কৌশল গ্রহণের। প্রথমত, বাংলাদেশকে তার বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে। মোংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সরাসরি রপ্তানি ব্যবস্থায় প্রবেশ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত, যাতে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে পারে এবং ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার প্রয়োজন ছাড়াই বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারে।
এছাড়া, লজিস্টিকস খাতের উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী করা সম্ভব হবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য, বাংলাদেশ সরকারকে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য আরও সহজে প্রবেশ করতে পারে।একইভাবে, বাংলাদেশে নতুন দূতাবাস প্রতিষ্ঠা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রসার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে কিছু দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে অনুপস্থিত, ফলে সেসব দেশের নাগরিকরা ভারতে অবস্থিত দূতাবাসের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে এই দূতাবাসগুলোর প্রতিষ্ঠা সরকার ও রাষ্ট্রীয় পলিসি মেকারদের উদ্যোগে সম্ভাব্য হতে পারে, যা আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। চিকিৎসা ব্যবস্থাও উন্নতি করতে হবে।উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় প্রাধান্য হওয়া উচিত, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা একটি দেশের শক্তিশালী এবং উন্নত স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা দেখতে চায়, কারণ এটি একটি দেশের কর্মশক্তির দক্ষতা এবং দেশটির সার্বিক উন্নতি নির্দেশ করে। দেশের স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন ঘটালে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে।
গ্লোবালাইজেশনের যুগে অর্থনীতি হচ্ছে দাবা খেলার গুটি চাল দেওয়ার মতো। রাষ্ট্রের পলিসি মেকারেরা যে যার ইচ্ছা মতোন গুটি চাল দিচ্ছে। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করছে, তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে চাল দিচ্ছে নিজের দেশের কল্যাণ( ওয়েল-বিয়িং)-এর জন্য। এটাই ভূ-রাজনীতি।
ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, কিন্তু এটিকে সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ কেবল এই ধাক্কা সামলানো কষ্টদায়ক হলেও ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে। সময় এসেছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।পাশাপাশি, বাংলাদেশেও নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। শুধু পোশাক শিল্পেই নয়, দেশের অন্যান্য শিল্প খাতগুলোর জন্যও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আরো বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) দ্রুত বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি বিভাগ।
আমার বার্তা/সাদিক আহমেদ প্রান্ত/এমই