ই-পেপার রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১

নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নেই, তবু গলা ফাটাচ্ছে দলগুলো

মো. ইলিয়াস বিন কাশেম:
১০ এপ্রিল ২০২৫, ২১:৩৯

দেশের রাজনীতিতে যখনই নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, তখন এক অদ্ভুত উন্মাদনা আমাদের ঘিরে ধরে। চারদিকে জ্বালাময়ী বক্তব্য, পোস্টার-ফেস্টুনে ছেয়ে যাওয়া শহর, মিডিয়ায় মুখর রাজনীতিকদের প্রতিযোগিতামূলক বাক্যবাণ। অথচ যখন আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করি, দেখতে পাই এই আওয়াজের পেছনে আদতে কোনো বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতির ছিটেফোঁটাও নেই। প্রস্তুতি নেই নীতিগত, আদর্শগত বা সংগঠনভিত্তিক কোন পর্যায়েই। রাজনীতির মঞ্চে এখন যেন প্রচারের হাইড্রোজেন বেলুন ছাড়া আর কিছুই নেই—ভেতরে ফাঁপা, উপরে চকচকে।

আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে 'অগণতান্ত্রিক', 'জনবিচ্ছিন্ন' কিংবা 'রাষ্ট্রবিরোধী' বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আসলে কে কতটা জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত? কে কতটা গণতন্ত্র চর্চায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? আর কে কতটা নির্বাচনকে একটি পবিত্র জাতীয় প্রক্রিয়া হিসেবে সম্মান করে?

নির্বাচনের প্রস্তুতি: কেবল মুখে মুখেই?

নির্বাচনের প্রস্তুতি বলতে আমরা কী বুঝি? একটি রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনের দিকে এগোয়, তখন তার অন্তত তিনটি প্রস্তুতি থাকা দরকার:

১. নীতিগত প্রস্তুতি—যেখানে দলটি জনগণের সামনে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভবিষ্যৎ রূপরেখা এবং জাতীয় সংকটের সমাধান উপস্থাপন করে।

২. সংগঠনভিত্তিক প্রস্তুতি—যেখানে দলীয় কর্মী ও নেতা-কর্মীরা মাঠে সক্রিয় হয়ে জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলে।

৩. নৈতিক প্রস্তুতি—যেখানে দলটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রতি সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে নিজেদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাখে।

অথচ বাস্তবে আমরা দেখছি, রাজনৈতিক দলগুলো 'নির্বাচন' শব্দটি উচ্চারণ করতেই যেন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে কে কতটা উচ্চস্বরে চিৎকার করতে পারে! কেউ বলছে, “এই সরকার থাকলে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না”, কেউ বলছে, “তারা নির্বাচন চায় না, চায় বিশৃঙ্খলা।” কেউ আবার বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ত, যেন জাতীয় নির্বাচন নয়, জাতিসংঘের কোনো রেজ্যুলুশন পাশ করাতে চাচ্ছে!

গলার আওয়াজ বনাম মাঠের বাস্তবতা

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর গলার আওয়াজ যত উচ্চ, মাঠপর্যায়ে তাদের প্রস্তুতি ততই দুর্বল। বিএনপি দীর্ঘ সময় ধরে রাজপথে থাকলেও জনসংযোগ কার্যক্রম বা রাজনৈতিক বিকল্প রূপরেখা স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেবল সরকারের পদত্যাগ দাবি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় থেকেছে, কিন্তু যদি আগামীকালই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়—তাদের কতগুলো আসনে প্রার্থী প্রস্তুত আছে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বে থাকলেও দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে যে বিশৃঙ্খলা ও নেতৃত্বে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের লবিং এবং ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ—সবমিলে দলটি চাপে আছে। দলের একটি বড় অংশ সরকার পরিচালনার ভারে ক্লান্ত; অন্য অংশটি ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

জাতীয় পার্টির মত তথাকথিত 'তৃতীয় শক্তি' শুধু নির্বাচনের সময় কিছু আসন ও সুবিধা পেতে ব্যস্ত। আদর্শ, নীতি বা পরিবর্তনের বার্তা—এসব তাদের বিবেচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

জনগণ কী চায়?

জনগণ এখন আর অতীতের মত শুধু প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখে না। তারা দেখতে চায়, কোন দল তাদের জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারবে—চাকরি, নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাব্যবস্থা, এবং সর্বোপরি—গণতন্ত্র ও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এই সব বিষয়ে সংলাপ চালানোর চাইতে পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার করতে বেশি ব্যস্ত। তাই জনগণের মনে একধরনের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে—"সব দলেরই মুখোশ পড়া" এই ধারণা বাড়ছে।

বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই অনাস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। যারা ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অংশ ছিল, তারা আজ নিজেরাই প্রশ্ন করছে—“আমরা কি আসলেই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত? নাকি আমরা আবারও পুরনো চক্রেই আটকে যাব?”

বিদেশ নির্ভরতা বনাম নিজস্ব রাজনৈতিক সাহস

আমাদের রাজনীতির আরেকটি দুঃখজনক দিক হলো—নিজস্ব রাজনৈতিক সাহসের অভাব। বড় দুই দলই এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটের সমাধান বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যস্থতায় খুঁজছে। কখনো জাতিসংঘ, কখনো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কখনো মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন তারা এসে “বাংলাদেশ সমস্যার” সমাধান দিয়ে যাবে।

আসলে এটি একধরনের রাজনৈতিক পরাজয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা, দ্বন্দ্ব নিরসন বা আলোচনার পথে হাঁটতে ভয় পায়। গণতন্ত্র মানে তো মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আলোচনায় বসা। কিন্তু আমরা দেখি, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সবাই ধরে নিয়েছে যে “আমার না হলে কারও না”। এই প্রবণতা ধ্বংসাত্মক।

মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

মিডিয়া এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজও এই গলা ভরা আওয়াজে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেছে। কেউ পক্ষ নিচ্ছে, কেউ বিপক্ষে, কিন্তু সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো কমে গেছে। টকশো যেন একেকটি রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চ, যেখানে যুক্তির চেয়ে আবেগ ও দলীয় আনুগত্য বেশি গুরুত্ব পায়।

বুদ্ধিজীবী সমাজও এখন বিভক্ত। কেউ দলের পদ-পদবীর আশায় মৌন, কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ ঝাড়ছেন। কিন্তু যেটা দরকার—একটি স্পষ্ট, ন্যায়ভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান—তা অনুপস্থিত।

পথ কী?

এই অচলাবস্থার মধ্য থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, শুধু গলার আওয়াজে বা শক্তি প্রদর্শনে জনগণ আস্থা ফিরে পাবে না। বরং দরকার হবে—

১. গঠনমূলক সংলাপ

২. ভবিষ্যৎমুখী নির্বাচনী রূপরেখা উপস্থাপন

৩. দলীয় গণতন্ত্র চর্চা এবং প্রার্থী নির্বাচনে স্বচ্ছতা

৪. জনগণের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি

সকল পক্ষকেই কিছুটা ছাড় দিতে হবে, কিছুটা আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ নয়, ‘প্রতিযোগী’ হিসেবে দেখতে পারলে তবেই আমরা একটি অর্থবহ নির্বাচন এবং কার্যকর গণতন্ত্রের দিকে এগোতে পারব।

একটি রাষ্ট্রে নির্বাচন মানে কেবল ভোটদান নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যদি প্রস্তুতির অভাব থাকে, যদি তা কেবল আওয়াজে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে গণতন্ত্র শুধু নামমাত্র থাকবে, কার্যকর হবে না। আমাদের দরকার—গলার আওয়াজ কমিয়ে মাঠে বাস্তব প্রস্তুতি বাড়ানো। দেশকে বাঁচাতে হলে, নির্বাচনকে বাঁচাতে হবে। নির্বাচনকে বাঁচাতে হলে, রাজনীতিকে ফেরাতে হবে নীতি ও মানবিকতায়।

লেখক: সাংবাদিক ও সাবেক শিক্ষার্থী লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আমার বার্তা/মো. ইলিয়াস বিন কাশেম/এমই

বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও বৈশ্বিক অস্থিরতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অনন্য সাধারণ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি মার্কিন শাসন বিভাগের প্রধান

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সংঘাত: বাংলাদেশের ভবিষ্যত পথ কী?

বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে বন্ধু রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। এক একটি পরিস্থিতি একেকটি সঙ্কটে পরিণত হতে পারে,

সমাজে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব কাটিয়ে শান্তি স্থাপন করতে হবে

১০ এপ্রিল ২০২৫, ঢাকার চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো এক ঐতিহাসিক আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এই

শান্তির মুখোশে সংঘাত : ইসরায়েল ও আরব জোটের বাস্তবতা

ইসরায়েল ও আশপাশের মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই চিত্র অনেকটাই বদলে
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা মহানগর পুরাতন গাড়ি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নির্বাচন

সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ প্রধান উপদেষ্টার

ঢাকা ডার্বিতে মোহামেডানের জয়

রাশিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সফর শেষে দেশে ফিরলেন সেনাপ্রধান

মডেল মেঘনা আলমের সহযোগী পাঁচ দিনের রিমান্ডে

‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন হাজারো মানুষ

পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিলল রেকর্ড সংখ্যক টাকা ও স্বর্ণালংকার

ভেন্যু জটিলতায় পিছিয়ে যাচ্ছে বিসিএল

পুলিশে চাকরি দেওয়ার নামে লেনদেনে দুইজন গ্রেপ্তার

গাজার পুরো ‘মোরাগ’ করিডর দখল করল ইসরায়েল

পিন ছাড়াই বিকাশ পেমেন্টে রিচার্জ সুবিধা চালু রবি ও এয়ারটেলের

সফলতার পথে যেভাবে এগিয়ে যাবেন

ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার ও গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি

কাঁচা আমের উপকারীতা

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কামনায় মোনাজাতে কাঁদলেন লাখো মানুষ

স্লোভাকিয়ার প্রতি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের আহ্বান

জনতার মহাসমুদ্র ফিলিস্তিন ও আল আকসার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ

ঈদের ছুটির পর সচল পোশাক কারখানা

এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে তরুণ আটক

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা শুরু