ইসরায়েল ও আশপাশের মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। এখন একাধিক আরব রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত বিভিন্নভাবে ইসরায়েলকে সহায়তা করছে। এই সহযোগিতাগুলো ইসরায়েলের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হচ্ছে এবং তাকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলছে—যদিও এসব সম্পর্ক প্রায়ই গোপনে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর ও জর্ডানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে হাঁটছে, যা বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা : ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক গত কয়েক বছরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের বাণিজ্য ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
এই চুক্তি কেবল বাণিজ্যিক সম্পর্ককেই শক্তিশালী করেনি, বরং অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিনিয়োগেরও পথ তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আরব আমিরাতের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের থার্ডআই সিস্টেমসে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা ইসরায়েলের সামরিক শিল্পকে শক্তিশালী করছে। এটি ইসরায়েলকে তার প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাতে অগ্রগতির সুযোগ দিয়েছে। একইভাবে, মিশর এবং জর্ডানও ইসরায়েলের সঙ্গে কৃষি, পানি এবং শক্তির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক সমঝোতা : রাজনৈতিকভাবে, কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করেছে। সৌদি আরব ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও, ইরানবিরোধী অবস্থান তাদেরকে ইসরায়েলের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ২০২৪ সালে, সৌদি আরব তাদের আকাশসীমা ইসরায়েলি এবং মার্কিন বিমানের জন্য খুলে দেয়, যা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা প্রতিরোধে সহায়ক হয়। এছাড়া, মিশর ও জর্ডানও ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং একে অন্যের নিরাপত্তার জন্য সমন্বয় করে যাচ্ছে। বাহরাইন এবং মরক্কো আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যা আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নতা কমিয়েছে এবং আঞ্চলিকভাবে তার শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে।
সামরিক সহযোগিতা : আরব দেশগুলোর ভূখণ্ড এবং সুবিধা ইসরায়েলের সামরিক সুবিধা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়। সৌদি আরব এবং জর্ডান ২০২৪ সালে ইরানি হামলা প্রতিহত করতে ইসরায়েলি বিমান এবং মার্কিন সামরিক শক্তির জন্য আকাশসীমা খুলে দেয়। এ ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়ে থাকে, যা ইসরায়েলকে আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী করার একটি সহায়ক উপাদান।
কৌশলগত স্বার্থ : ইরান বিরোধী অবস্থানে আরব দেশগুলোর স্বার্থ ইসরায়েলের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা কৌশলগত সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি করে এবং ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখার কারণে তাদের স্বার্থ একে অপরের সঙ্গে মেলে। জর্ডান এবং মিশরের অবস্থানও একইভাবে ইসরায়েলের পক্ষকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছে। তারা শান্তি বজায় রাখার পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, যা আঞ্চলিকভাবে ইসরায়েলের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
জনমতের বিপরীতে সরকারি নীতি : এমনকি ইসরায়েলকে সহযোগিতা করার পরও, আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি বিরোধী মনোভাব বজায় রয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতির অভাব ও ইসরায়েলের প্রতি সরকারগুলোর সমর্থন এ দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয়। সরকারগুলো জনগণের সমালোচনার হাত থেকে বাঁচতে এ সম্পর্কগুলি গোপনে রাখতে চেষ্টা করছে। যদিও কিছু সময় প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন দেখানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে এই সম্পর্কগুলির উন্নতি ঘটছে।
নৈতিক ব্যর্থতা ও এর প্রভাব: আরব বিশ্ব ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিন আন্দোলনের অন্যতম অভিভাবক ছিল। কিন্তু আজ সেই অভিভাবকতা হ্রাস পেয়েছে। এই নীরবতা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে ভাঙন ধরাচ্ছে এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক দুর্বলতা তুলে ধরছে। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। ফিলিস্তিন ইস্যু শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি একটি ন্যায়-অন্যায়, মানবতা ও নিপীড়নের লড়াই। আরব নেতাদের নীরবতা এ নিপীড়নকে বৈধতা দিচ্ছে, যা শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্যই হুমকি। এই অবস্থান পরিবর্তনের জন্য দরকার আরব জনগণের শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাপ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ কূটনীতি। নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট না করলে আজ যারা নীরব, কাল তারা নিজেরাই নিপীড়নের শিকার হতে পারেন।
এখনকার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, আরব দেশগুলোর ইসরায়েলের প্রতি এই সহযোগিতা এক নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করছে। এর ফলে ইসরায়েল তার আঞ্চলিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে, যদিও এটি ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিন ও মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিরোধপূর্ণ বিষয়। এমনকি, এই সহযোগিতার মধ্যে গোপন এবং প্রকাশ্য সমঝোতাগুলো আরব দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত কৌশলগত, যা ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চিত্রে আরো গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : অনলাইন ইনচার্জ, দৈনিক আমার বার্তা।
আমার বার্তা/মোহাম্মদ ইয়ামিন/এমই