ই-পেপার রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

সমাজে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব কাটিয়ে শান্তি স্থাপন করতে হবে

বিল্লাল বিন কাশেম
১০ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:১৩
আপডেট  : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ২১:৪২

১০ এপ্রিল ২০২৫, ঢাকার চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো এক ঐতিহাসিক আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এই অনুষ্ঠান ছিলো এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতারা একত্রিত হয়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও সহনশীলতার বার্তা নিয়ে আলোচনা করেন। উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চের মহাসচিব রেভারেন্ড প্রফেসর ড. জেরি পিল্লে, ন্যাশনাল চার্চ কাউন্সিল অব বাংলাদেশের মহাসচিব রেভারেন্ড ডেভিড অনিরুদ্ধ দাস, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আঃ ছালাম খান, ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনসহ দেশের বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ।

এই সংলাপে ইসলাম ধর্মের পক্ষে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়ে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং একে মানবতার পথে সাহসী অগ্রযাত্রা হিসেবে বিবেচনা করি। এই ধরনের সংলাপ বর্তমান বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ

বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা এবং উগ্র মতবাদের ক্রমবর্ধমান প্রেক্ষাপটে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষ, সিরিয়া ও ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ, আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দাঙ্গা—সবই নির্দেশ করে যে, ধর্মের অপব্যাখ্যা কিভাবে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনছে।

এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসলামভীতি (ইসলামোফোবিয়া) ও বর্ণবিদ্বেষ, এবং ভারতে ধর্মনির্ভর জাতীয়তাবাদ ও সহিংস উগ্রবাদ সমাজকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপ একটি আলোচনাভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যেখানে সহনশীলতা, বোঝাপড়া ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সমাধানের পথ খোঁজা যায়।

আঞ্চলিক বাস্তবতায় সংলাপের প্রাসঙ্গিকতা

দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য বহন করে আসছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা—সব দেশেই একাধিক ধর্মাবলম্বী মানুষের সহাবস্থান বিদ্যমান। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও ধর্মীয় বিভাজনের ঘটনা বাড়ছে। ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, গরু-রক্ষার নামে সহিংসতা, কাশ্মীর ইস্যুতে ধর্মীয় উত্তেজনা, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন এবং শ্রীলঙ্কায় গির্জায় বোমা হামলা দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

এই অঞ্চলে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ শুধু শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য নয়, সামাজিক ঐক্য, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং মানবিক সহাবস্থানের জন্য অপরিহার্য। দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা গড়ে তুলতে মিডিয়া, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সংলাপের পরিধি বিস্তৃত করতে হবে।

ইসলামে আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান ও সহনশীলতা

ইসলাম শান্তির ধর্ম। "ইসলাম" শব্দের মধ্যেই রয়েছে শান্তি ও আত্মসমর্পণের অর্থ। ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতার একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা কুরআনের বহু আয়াতে প্রতিফলিত হয়েছে।

“লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন।” (সূরা কাফিরুন: ৬)

অর্থ: "তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম।"

এই আয়াত ইসলামের ধর্মীয় সহনশীলতার ভিত্তি। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় একটি বহুধর্মীয় সমাজে বসবাস করতেন। মদিনা সনদ একটি যুগান্তকারী দলিল, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা একত্রে সহাবস্থানের জন্য একমত হয়েছিলেন।

মুসলিম শাসনামলে স্পেনের কর্ডোভা বা ভারতবর্ষে আকবরের দীন-ই-ইলাহি উদ্যোগ ধর্মীয় সহাবস্থানের ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত। এসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বর্তমান সময়ে পথ দেখাতে পারে।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির ধারা

বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই দেশে ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের অনুসারীরা দীর্ঘকাল ধরে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির পরিবেশে বসবাস করছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শন ছিল: “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।” এই নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার এক মৌলিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন উৎসবে সব ধর্মের মানুষ একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগ করে নেন। ঈদে হিন্দু-খ্রিস্টান বন্ধুদের আমন্ত্রণ, পূজায় মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণ, বড়দিনে সকলের উপস্থিতি—এসবই আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতিচ্ছবি।

চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সংলাপের তাৎপর্য

ঢাকায় চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অনুষ্ঠানে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা অংশ নিয়ে আলোচনা করেছেন ধর্মীয় সহাবস্থান ও সমাজে ধর্মীয় নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে।

এই সংলাপে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল—ধর্মীয় নেতারা কীভাবে উগ্রতা দমনে ভূমিকা রাখতে পারেন, কীভাবে তাঁরা তরুণ সমাজকে মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, এবং কীভাবে ধর্মকে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সম্প্রীতির বাহনে রূপান্তর করা যায়।

তরুণ সমাজ: পরিবর্তনের হাতিয়ার

ধর্মীয় সম্প্রীতির সবচেয়ে শক্তিশালী বাহক হলো তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের শিক্ষিত, প্রযুক্তিপ্রবণ ও সৃজনশীল যুবসমাজ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। তাদের মাঝে আন্তঃধর্মীয় বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলে আন্তঃধর্মীয় কর্মশালা, নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে। পাঠ্যপুস্তকে সম্প্রীতির ইতিবাচক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ধর্মীয় বিষয়গুলো যেন বিদ্বেষের নয়, মানবতার শিক্ষা দেয়—এটা নিশ্চিত করতে হবে।

গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্ব

গণমাধ্যম একটি সমাজের দর্পণ। আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতির পক্ষে গণমাধ্যমকে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। নিউজ রিপোর্ট, টকশো, ডকুমেন্টারি এবং ব্যক্তিগত গল্প—সব মাধ্যমেই সহনশীলতা ও মানবিকতার বার্তা ছড়াতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়াতে গুজব, উস্কানিমূলক বক্তব্য ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তরুণরা যেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ইতিবাচক বার্তা প্রচার করে, এ জন্য প্রশিক্ষণ ও কনটেন্ট ক্রিয়েশন কর্মসূচি চালু করা জরুরি।

প্রয়োজনীয় করণীয় ও কর্মপরিকল্পনা

১. ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ: সহনশীলতা, মানবিকতা ও শান্তির বার্তা প্রচারে ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ প্রদান।

২. পাঠ্যক্রমে সম্প্রীতির অন্তর্ভুক্তি: স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে আন্তঃধর্মীয় বোঝাপড়া ও সম্প্রীতির ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা।

৩. সম্প্রীতির সামাজিক আন্দোলন: নাগরিক উদ্যোগে ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলা।

৪. আইনের প্রয়োগ: ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য ও ঘৃণার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ।

৫. মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক ব্যবহার: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির গল্প ও উদাহরণ তুলে ধরা।

ধর্ম মানুষের আত্মিক উন্নয়নের জন্য। এটি যদি হিংসা, ঘৃণা ও বিভাজনের কারণ হয়, তবে তা মানুষের ধর্ম নয়—মানবতার অপমান। আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি মানবিক, সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন সম্ভব। ধর্মীয় নেতারা হোক পরিবর্তনের অগ্রদূত। তরুণরা হোক সম্প্রীতির বার্তাবাহক।

আসুন, আমরা সকলে মিলিতভাবে ধর্মকে বিভাজনের নয়, সংহতির মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। আন্তঃধর্মীয় সংলাপ হোক একটি সচেতনতা-জাগরণ, একটি সামাজিক আন্দোলন এবং একটি মানবিক বিপ্লবের সূচনা।

ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গণসংযোগ কর্মকর্তা

বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও বৈশ্বিক অস্থিরতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অনন্য সাধারণ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি মার্কিন শাসন বিভাগের প্রধান

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সংঘাত: বাংলাদেশের ভবিষ্যত পথ কী?

বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে বন্ধু রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। এক একটি পরিস্থিতি একেকটি সঙ্কটে পরিণত হতে পারে,

নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নেই, তবু গলা ফাটাচ্ছে দলগুলো

দেশের রাজনীতিতে যখনই নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, তখন এক অদ্ভুত উন্মাদনা আমাদের ঘিরে ধরে। চারদিকে জ্বালাময়ী

শান্তির মুখোশে সংঘাত : ইসরায়েল ও আরব জোটের বাস্তবতা

ইসরায়েল ও আশপাশের মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই চিত্র অনেকটাই বদলে
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা মহানগর পুরাতন গাড়ি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নির্বাচন

সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ প্রধান উপদেষ্টার

ঢাকা ডার্বিতে মোহামেডানের জয়

রাশিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সফর শেষে দেশে ফিরলেন সেনাপ্রধান

মডেল মেঘনা আলমের সহযোগী পাঁচ দিনের রিমান্ডে

‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন হাজারো মানুষ

পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিলল রেকর্ড সংখ্যক টাকা ও স্বর্ণালংকার

ভেন্যু জটিলতায় পিছিয়ে যাচ্ছে বিসিএল

পুলিশে চাকরি দেওয়ার নামে লেনদেনে দুইজন গ্রেপ্তার

গাজার পুরো ‘মোরাগ’ করিডর দখল করল ইসরায়েল

পিন ছাড়াই বিকাশ পেমেন্টে রিচার্জ সুবিধা চালু রবি ও এয়ারটেলের

সফলতার পথে যেভাবে এগিয়ে যাবেন

ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার ও গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি

কাঁচা আমের উপকারীতা

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কামনায় মোনাজাতে কাঁদলেন লাখো মানুষ

স্লোভাকিয়ার প্রতি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের আহ্বান

জনতার মহাসমুদ্র ফিলিস্তিন ও আল আকসার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ

ঈদের ছুটির পর সচল পোশাক কারখানা

এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে তরুণ আটক

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা শুরু