সারা বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন সার্ভিসের চাহিদা বাড়ছে। যা আগামী ৪-৫ বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলারকে ছাড়িয়ে যাবে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টরে দক্ষ জনশক্তি দরকার। আর এই সেক্টরে দক্ষ জনবল তৈরিতে কাজ করছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান উল্কাসেমি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর খাত নিয়ে। তিনি তুলে ধরেছেন খাতের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়। সঠিক সময়ে নিজেদের তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল রয়েছে বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমানের মতে, বাংলাদেশের জন্য সেমিকন্ডাক্টর অন্যান্য খাতের তুলনায় নতুন। তাই সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সময় লাগছে। গত ১৮ বছরে উল্কাসেমি অনেক ইঞ্জিনিয়ার প্রস্তুত করেছে।
যারা দেশে এবং দেশের বাইরে উল্কাসেমির হয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। বাংলাদেশের যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ভিএলএসআই কোর্স রয়েছে, এখান থেকে কেবল বইয়ের জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। তবে ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অনুযায়ী এই প্রশিক্ষণে আরো পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি জানান তিনি।
অন্যদিকে ভিএলএসআই পাঠ্যসূচিতে চাইলেই দ্রুত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার্থীদের ভিএলএসআইতে আগ্রহী করে তুলতে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্কাসেমি। এর মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং, ব্লগ, সেমিনার, কনফারেন্স, ভিএলএসআই প্রতিযোগিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আরো অনেক শিক্ষণীয় কার্যক্রম অন্যতম।
সারা বিশ্ব আগামী দিনের নতুন প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক ছেলেমেয়েরা ইন্টেল, অ্যাপেলের মতো কোম্পানিতে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। আমরা চেষ্টা করলেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারি। যদিও এই কাজটা সময়সাপেক্ষ এবং তুলনামূলক চ্যালেঞ্জিং। তবে অসম্ভব নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট স্মার্ট, তারা নতুন বিষয় দ্রুত শিখে নিতে পারে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যদি সঠিক পরিবেশ, পর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, তবে তারাও ভালো করতে পারবে।’
সারা বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টর খাতে এখন ১ মিলিয়ন দক্ষ জনশক্তি দরকার। এরই ফলপ্রসূতে মালয়েশিয়া ৬০ হাজার জনশক্তি তৈরির পরিকল্পনা করেছে। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত কেবল ৪০ হাজার জনশক্তি তৈরি করতে পেরেছে দেশটি। ভারতের পরিকল্পনা ৩ লক্ষ এবং ভিয়েতনামের পরিকল্পনা ৫০ হাজার জনশক্তি তৈরি করা। বাংলাদেশও এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান জানান, সারা বিশ্ব এখন পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপে টালমাটাল পরিস্থিতিতে রয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইনে শুল্ক আরোপ হয়নি। সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইনে শুল্ক আরোপ হলে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাবে। এতে আমাদের পাশাপাশি আমেরিকার অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে পারে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে প্রথমবারের মতো টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটিতে একাডেমিয়া সদস্য হিসেবে বুয়েট, ব্র্যাক, এমআইএসটির শিক্ষকরা আছেন। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রি থেকে রয়েছেন মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান। এখনো সেমিকন্ডাক্টরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বেশি জোর দিয়েছি। সেমিকন্ডাক্টর মূলত নলেজ ইন্ডাস্ট্রি এবং উচ্চ বেতনের সেক্টর। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারলে অন্যান্য খাতের মতো এই খাতও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। দেশের ভালোর জন্য এই খাতকে আরো গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিডা আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫’। সম্মেলনে ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। আইসিটি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় সেক্টর হিসেবে সেমিকন্ডাক্টরকে তুলে ধরা হয়েছে এই আয়োজনে। এই ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করতে এবং বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টরা। আয়োজনে এক্সপার্ট স্পিকার হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান।
তিনি বলেন ‘আয়োজনে বাংলাদেশে আইসিটি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী অনেক বিনিয়োগকারী এসেছেন। যার ফলশ্র“তিতে এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আশার সুযোগ সৃষ্টি হবে। শুরুর দিকে টেক জায়েন্টদের বোঝাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমাদের কর্মদক্ষতা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হয়েছে। এখন আমরা মোটামুটি সফল। তবে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর মার্কেটে ভালো স্থান করে নিতে হলে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
ইতিমধ্যে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি ইউরোপ, আমেরিকা এবং চীন এই তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে কোনো একক দেশের সঙ্গে ব্যবসা করে এই সেক্টরে শক্ত অবস্থান ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে সবার সঙ্গে কাজ করে এই সেক্টরের উন্নতি করা এবং আরো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
আমার বার্তা/এল/এমই