ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের টেকনিক্যাল কমিটিতে থাকা তাঁর জন্য সমীচীন নয়। স্বার্থের সংঘাতের শঙ্কা থাকে। কাজেই টেকনিক্যাল কমিটিতে তিনি থাকবেন না। যদিও এনামুলের সরে যাওয়ার আসল কারণ এটি নয়।
কাল বিসিবির আম্পায়ার্স বিভাগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন দেশের সেরা এবং আইসিসির এলিট প্যানেলে বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র প্রতিনিধি শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ। পদত্যাগপত্রে তিনি কী লিখেছেন জানা যায়নি। তবে কারণ অনেকটাই প্রকাশ্য।
মোহামেডানের অধিনায়ক তাওহিদ হৃদয়কে নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ওঠা সাম্প্রতিক বিতর্কই এর কারণ। দুই ম্যাচ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা এই ক্রিকেটারকে নিষেধাজ্ঞা শেষ না হতেই একপ্রকার জোর করে খেলিয়ে দেওয়া একজন আম্পায়ার হিসেবে মেনে নিতে পারেননি শরফুদ্দৌলা।
যেহেতু আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচের দিন মাঠে অখেলোয়াড়োচিত আচরণ এবং চরম শৃঙ্খলাভঙ্গের কাজটা হৃদয় তাঁর সঙ্গেই করেছিলেন, ম্যাচ শেষে জাতীয় দলের এই ক্রিকেটার সংবাদমাধ্যমের সামনে ‘ঘটনা অন্যদিকে’ গেলে ‘মুখ খোলার’ কথাও বলেন; মোহামেডান অধিনায়কের শাস্তি কমানোর অন্যায় সিদ্ধান্ত শরফুদ্দৌলার মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আম্পায়ারের মেনে নিতে না পারাটাই স্বাভাবিক।
বিষয়টি নিয়ে কেউ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ না খুললেও এটা নিশ্চিত— হৃদয়ের শাস্তি কমানোর সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েই শরফুদ্দৌলা মাসিক ২ লাখ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়ে বিসিবিতে চিঠি দিয়েছেন। হৃদয়ের শাস্তি যে প্রক্রিয়ায় কমানো হয়েছে, তা সঠিক নয় বলে মনে করেন তিনি।
অপমানিত বোধ করছেন এই ভেবে যে, আম্পায়ার হিসেবে এতে তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর আগে এনামুল হকের টেকনিক্যাল কমিটি থেকে সরে যাওয়াটাও ছিল এই অনিয়মের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ।
সাবেক বাঁহাতি স্পিনার এনামুল দীর্ঘদিন জাতীয় দলে খেলেছেন। খেলা ছেড়ে আম্পায়ারিংয়ে আসার পর যত দিন কাজটা করেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনামের সঙ্গেই তা করেছেন। জাতীয় দলে না খেললেও শরফুদ্দৌলা বাংলাদেশ ‘এ’ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট।
তাঁদের মতো সাবেক ক্রিকেটাররা আম্পায়ারিংয়ে এলে দেশের ক্রিকেটের এই জায়গাটা সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু অনেক বছর ধরে চলে আসা অসুস্থ-নোংরা ক্লাব রাজনীতি দেশের ক্রিকেটের আরও অনেক কিছুর মতো বারোটা বাজিয়ে চলেছে।
আম্পায়ারদের ওপর ক্লাবের দমন-পীড়ন বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন নয়। নাজমুল হাসানের বিগত বোর্ডের সময় সেটি চরম আকার ধারণ করেছিল। ঢাকা লিগের প্রতিটি স্তরে আম্পায়ারদের ওপর প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে সেই সময়।
একটা পর্যায়ে তো অলিখিতভাবে বোর্ডের কোটারিভূক্ত একদল আম্পায়ারই সৃষ্টি হয়ে যায়, যারা নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে মাঠে আঙুল তুলতেন বিসিবির কিছু কর্মকর্তার ইচ্ছায়। বিনিময়ে পেতেন বেশি বেশি ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ এবং অন্যায্য সব সুবিধা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের কলঙ্কজনক অনেক কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তখনকার নোংরা পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং।
সরকার পরিবর্তনের পর জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মনোনীত পরিচালক হিসেবে বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর অন্যতম ছিল মাঠের ক্রিকেটকে ঠিক করা। খেলাটার সঙ্গে সরাসরি যারা সম্পৃক্ত—খেলোয়াড়, কোচ, আম্পায়ার, কিউরেটর, গ্রাউন্ডসম্যানদের মানোন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। স্পষ্টভাষী ফারুকের কথা আশাবাদী করেছিল সবাইকে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! ফারুক আহমেদ ওরকম নিশ্চয়তা দেওয়ার পরও কিনা তাঁর সময়েই দেশের সেরা আম্পায়ার একটা ক্লাবের কর্মকাণ্ডে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে আর ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারিং করতে চাচ্ছেন না! আগের বোর্ডের সময় কতিপয় ক্লাব কর্মকর্তার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতেন তুলনামূলক পেছনের সারির আম্পায়াররা। ওপরের দিকের আম্পায়ারদের সঙ্গে অসম্মানজনক কিছু করার নজির তেমন নেই।
কিন্তু এখন তো শরফুদ্দেৌলার আগে দেশের সাবেক সেরা আম্পায়ার এনামুলও সরে দাঁড়িয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের টেকনিক্যাল কমিটি থেকে।
যে প্রক্রিয়ায় শাস্তিপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হৃদয়কে এক ম্যাচের বহিষ্কারাদেশের (বহিষ্কারাদেশ ছিল ২ ম্যাচের) পরই মোহামেডান খেলিয়ে দিল, বিসিবি এবং আম্পায়ারদের জন্য সেটা চরম অবমাননাকরই। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ, যিনি বোর্ডের বাইরে থাকার সময় সব অনিয়মের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে সোচ্চার হতেন, বোর্ড সভাপতি হয়ে কি তিনি এসব আর দেখছেন না?
গত ১৭ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আবাহনীকে ‘দৈত্য’ হয়ে উঠতে দেখেছে সবাই। এখন সেই পথ ধরেছে মোহামেডান। আবাহনীর ‘দৈত্য’ হওয়াটা ছিল অনেক বছর ক্ষমতায় থাকাজনিত দম্ভ থেকে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে হঠাৎ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা মোহামেডান তো তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় আসার আগেই ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করেছে! প্রায় দেড় যুগের ক্ষুধা মেটানোর ‘ইনিংস’ খেলতে নেমে তাদের ‘উদ্বোধনী আচরণ’ দেখে ভয় হয়; আকাশি-নীলের চেয়ে সাদা-কালো দৈত্যটাই না বেশি বড় হয়ে যায়! বিসিবি পরিচালক নাজমূল আবেদীন যে বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনে ক্লাবের ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এসব কারণেই সেটিকে আরও বেশি যৌক্তিক মনে হয়।
আম্পায়ারিং নিয়ে বিগত বোর্ডের নির্লজ্জতা ঘরোয়া ক্রিকেটের গোড়াতেই পচন ধরিয়ে দিয়েছিল। বোর্ড কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পাতানো ম্যাচের রমরমাও বেড়েছিল তখন। এখন যখন সবাই আশায় আছে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে এসব নোংরামি দুর হবে, তখন উল্টো শীর্ষ আম্পায়াররাই অপমানের জ্বালায় মাঠ ছাড়তে চাইছেন।
শুধু তাই নয়, হৃদয়ের শাস্তিকে কেন্দ্র করে দু জন ম্যাচ রেফারির মধ্যে প্রায় হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে যেতে নিয়েছিল। এই ঘটনায় যিনি আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিলেন, তিনি আবার বিগত সরকারের আমলেও সব রকম সুযোগ-সুবিধা নেওয়া ম্যাচ রেফারি। বর্তমানে অবশ্য নিজের ‘বিএনপি কর্মী’ পরিচয়টাকে সামনে আনতেই তিনি বেশি আনন্দ পান।
গত ১২ এপ্রিল আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়ারের সঙ্গে অসদাচরণের অপরাধে এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় মোহামেডান অধিনায়ক তাওহিদ হৃদয়কে। তাঁর নামের পাশে যোগ হয় ৪টি ডিমেরিট পয়েন্ট, সঙ্গে করা হয় ৮০ হাজার টাকা জরিমানা। একই ঘটনায় মোহামেডানের পেসার ইবাদত হোসেনকেও জরিমানা করা হয় ৪০ হাজার টাকা।
এই শাস্তি পাওয়ার পরও মোহামেডানের ছায়ায় থাকা হৃদয় দমে যাননি। ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘটনা যদি অন্যদিকে যায়, আমি মুখ খুলব ইনশা আল্লাহ।’ হৃদয়ের এমন মন্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই শাস্তি বাড়িয়ে তাঁকে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও ডিমেরিট পয়েন্টের জন্য হৃদয়কে প্রথমেই ২ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারতেন ম্যাচ রেফারি, যেটি না করে তাঁকে একরকম ছাড়ই দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞাও মানেনি মোহামেডান ও হৃদয়। ১৭ এপ্রিল মিরপুরে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের (যেটি আসলে মোহামেডানেরই ছায়া দল) বিপক্ষে ম্যাচটিতে না খেললেও ২০ এপ্রিল বিকেএসপিতে অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে খেলেন। অথচ নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী ওই ম্যাচেও তাঁর মাঠের বাইরে থাকার কথা ছিল।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, হৃদয়ের শাস্তি কমানোর জন্য মোহামেডান সিসিডিএমে আবেদন করেছিল, সিসিডিএম যেটি ফরোয়ার্ড করে বিসিবির আম্পায়ার্স বিভাগে। কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটি আবেদনে সাড়া না দিলে মোহামেডানের চাপে বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটিই বাধ্য হয়ে হৃদয়ের শাস্তি কমায়।
আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান ইফতেখার আহমেদের হয়ে শাস্তি কমানোর চিঠিতে সই করেন আম্পায়ার্স বিভাগেরই এক কর্মকর্তা। প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বেআইনি ছিল কারণ, শাস্তি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো এখতিয়ারই নেই বিসিবির আম্পায়ার্স বিভাগের। এটি পারে কেবল টেকনিক্যাল কমিটি অথবা সিসিডিএম। তার মানে মোহামেডানের হয়ে অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে ম্যাচটা হৃদয় খেলেছেন বেআইনিভাবে, নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। যা একসময় যা করত আবাহনী, এখন তা করছে মোহামেডান।
জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারদের ওপর সব সময়ই একটা চাপ তৈরি করেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে মাঠে অতীতেও তাদের অশোভন আচরণ দেখা গেছে। সাকিব আল হাসানের লাথি মেরে স্টাম্প ভেঙে ফেলা যার বড় উদাহরণ। তবে সেসব ঘটনার জন্য তারকা ক্রিকেটাররা শাস্তিও পেয়েছেন। আর এখন শাস্তি হলেও ক্লাবের চাপে সেটা টিকছে না। আর হৃদয় তো এখনো সেই অর্থে তারকা হয়ে ওঠেননি। উঠতি ক্রিকেটারের গন্ধটাই যায়নি তার গা থেকে।
এখনই যদি তিনি মাঠে আম্পায়ারদের সামনে আঙুল উঁচাতে থাকেন, হুমকি দেওয়া শুরু করেন; ভবিষ্যতে কী হবে! জাতীয় দল নির্বাচক কমিটি যেসব বিবেচনায় বাংলাদেশ দলের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করেন, মাঠে হৃদয়দের মতো ক্রিকেটারদের বিশৃঙ্খল ও দাম্ভিক আচরণ থামাতে সেখানে বোধ হয় শৃঙ্খলার ঘরেও টিক
আফ্রিদি, ফরেস্ট গাম্প কিংবা এক চাটনিওয়ালার গল্প: ভারত-পাকিস্তান সিরিজে সবই আছে
মোহামেডানের চাপে হৃদয়-কাণ্ডের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটল, সেসব নিয়ে বিসিবিরও উচিত একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি করা। তাওহিদ হৃদয়, তাঁর ক্লাব মোহামেডান, ম্যাচ রেফারি, টেকনিক্যাল কমিটি, বিসিবির আম্পায়ার্স বিভাগ—কে, কোথায়, কেন, কীভাবে নিয়ম ভাঙলেন; তার তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা না নিলে বুঝে নিতে হবে দেশের ক্লাব ক্রিকেট আগের মতোই নোংরা এবং পচা রয়ে গেছে। ঘরোয়া ক্রিকেট এখনো চলে বিসিবির নির্বাচনী ছক মেনে, ‘ফারুক আহমেদের বোর্ড’কে আমরা তাই বলব ‘নাজমুল হাসানের ছায়া বোর্ড।’
আমার বার্তা/এল/এমই