দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেড়েই চলেছে। গত এক বছরেও উদ্ধার হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ফলে দিন দিন জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠ। মানুষ এখন অনেকটা অনিরাপদ। তবে সরকার ও পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেঃ জেনারেল (অবঃ) জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলমান। এখনো সব অস্ত্র ও গোলাবরুদ উদ্ধার হয়নি। তবে এ কারণে দেশব্যাপী চলছে শাঁড়াশি অভিযান। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রের সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেক অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের লেভেল থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়তো কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা উন্নতি হয়নি তা বলা সঠিক হবে না। মব সৃষ্টি এখন কমেছে বলেও তিনি দাবী করেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, লুণ্ঠিত অস্ত্রের ১ হাজার সাড়ে ৩০০ এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার হয়নি খোয়া যাওয়া সব গোলাবারুদ। এ লক্ষ্যে দেশব্যাপী অভিযান চলছে। আছে বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারী।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র মতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ও পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়ি কিংবা ক্যাম্প থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ৫১ হাজার ৯৫৯ রাউন্ড গোলাবারুদ লুট হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে লুট হওয়া ৪ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। সেই সাথে ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৩ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। তবে এখনো ১ হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র এবং ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১ রউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্রের কোন হদিস পাচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, শর্টগান, গ্যাস গান, কাঁদানো গ্যাস, লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের সেল, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে স্প্রে, বিভিন্ন বোরের গুলি এবং অত্যাধুনিক রাইফেলসহ বিভিন্ন ধরনের রাইফেল। সংসদ ভবন ও গণভবন থেকে লুট হয়েছে অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ওয়ারলেস সেট এবং প্রচুর গোলাবারুদ। পুলিশ বলছে, বৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে লাইসেন্স প্রাপ্ত বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০টি তন্মধ্যে ৪৫ হাজার ২২৬টি ব্যক্তির নামে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স রয়েছে ৫ হাজার ৮৪টি অস্ত্রের। লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্রের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে রয়েছে ৭ হাজার ৫৪৯টি অস্ত্র। এসব অস্ত্র নিয়ে তাদের নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে সেই সাথে রয়েছে খুনাখুনি-হামলা ও লুটপাটের হুমকি।
অপরাধী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসএসএফ-এর বিশেষায়িত অত্যাধুনিক ভারী ৩২টি অস্ত্র উদ্ধার না হওয়াতে নিরাপত্তা হুমকি বেড়েছে।
এদিকে পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, পুলিশের লুট হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার এখনো সম্ভব হয়নি। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে যেগুলো করা সম্ভব হয়নি সেগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে। তবে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
আইজিপি বলেন, সব অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সময় লাগবে। এজন্য সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বৈধ অবৈধ অস্ত্রের দাপটে সন্ত্রাসীরা যেমন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে, তেমনি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দিনে রাতে বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, দেশে শুধু আগ্নেয়াস্ত্র নয় প্রচুর দেশীয় অস্ত্রও রয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্রের সন্ধান দিলে পুরস্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈধ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাদের বৈধ অস্ত্র আছে তাদেরকেও নির্বাচনের আগে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিকটস্থ থানায় জমা দিতে হবে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, একটি মহল দেশে অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শুধু আগ্নেয়াস্ত্র নয় দেশীয় মারাত্মক অস্ত্র মজুদ করছে। পতিত সরকারের কিছু নেতাকর্মীর হাতে প্রচুর অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র দ্রুত উদ্ধার করতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নাশকতা, হত্যা, ডাকাতি নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটাতে তৎপর রয়েছে।
আমার বার্তা/এমই