ই-পেপার শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২ ভাদ্র ১৪৩২

রিসাইক্লিং থেকে রেভিনিউ : চক্রাকার অর্থনীতির বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

সাকিফ শামীম:
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:২৫

বর্তমান বিশ্বে দ্রুত শিল্পায়ন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাম্পিং গ্রাউন্ডে বর্জ্যের পাহাড় জমা হচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একই সঙ্গে, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় 'রৈখিক অর্থনীতি' (Linear Economy) অর্থাৎ 'ব্যবহার ও ফেলে দেওয়া'র মডেলের পরিবর্তে 'চক্রাকার অর্থনীতি' (Circular Economy) বা 'পুনঃব্যবহার ও পুনর্ব্যবহার' মডেলের দিকে ঝুঁকে পড়া এখন সময়ের দাবি। এই নতুন মডেল শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, বর্জ্যকে একটি মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরিত করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

ঐতিহ্যগতভাবে, বর্জ্যকে একটি মূল্যহীন পদার্থ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু চক্রাকার অর্থনীতিতে, বর্জ্যকে নতুন পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে দেখা হয়। চক্রাকার অর্থনীতি কেবল একটি পরিবেশগত ধারণা নয়, বরং একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক মডেল। এর মূল লক্ষ্য হলো সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে বর্জ্যকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা। এই দর্শনটি তিনটি মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত: এমনভাবে পণ্য ডিজাইন করা যেন তা বর্জ্য ও দূষণমুক্ত হয়, পণ্য ও কাঁচামালকে বারবার ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের জীবনকাল বাড়ানো এবং প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করা। এই পদ্ধতি রৈখিক অর্থনীতির একমুখী প্রবাহকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়।

প্রতিদিনের জীবনে চক্রাকার অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা আমরা সহজভাবে দেখতে পাই। যেমন, বাজার থেকে কেনা প্লাস্টিক বোতল বা প্যাকেট আমরা ফেলে না দিয়ে পুনঃব্যবহার করলে তার জীবনচক্র বাড়ে। ভাঙা আসবাবপত্র মেরামত করে আবার ব্যবহার করলে নতুন করে কাঠ কাটার প্রয়োজন হয় না। পুরোনো কাপড় পুনঃব্যবহার করে নতুন পণ্য তৈরি করা যায়। এমনকি বাড়িতে জৈব বর্জ্য আলাদা করে সার বানালে তা কৃষিতে কাজে লাগে। এভাবেই দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট অভ্যাস চক্রাকার অর্থনীতিকে বাস্তবে রূপ দেয়।

বর্জ্যকে একটি মূল্যহীন উপাদান হিসেবে ফেলে না দিয়ে, এটি তাকে নতুন কাঁচামাল ও সম্পদে রূপান্তরিত করে। এর ফলে শুধু উৎপাদন খরচই কমে না, বরং নতুন কর্মসংস্থান এবং ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়। সব মিলিয়ে, চক্রাকার অর্থনীতি এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়তা করে যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করা, পুরোনো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী থেকে মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার করা, বা জৈব বর্জ্য থেকে জৈব সার এবং বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। একইভাবে ব্যাটারি রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে সীসা, লিথিয়াম এবং নিকেলের মতো মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার করা যায়। এগুলো নতুন ব্যাটারি তৈরি, সোলার এনার্জি স্টোরেজ বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে শুধু পরিবেশ দূষণই কমে না, বরং আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়। এই পদ্ধতিগুলো কেবল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ কমায় না, বরং বর্জ্য নিষ্পত্তির খরচও হ্রাস করে। সঠিক বর্জ্য পৃথকীকরণ (segregation) এবং সংগ্রহ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পরে রিসাইক্লিং কেন্দ্রগুলোতে বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এটি একটি সুসংগঠিত সাপ্লাই চেইন, যা বর্জ্যকে 'কাঁচামাল' হিসেবে শিল্প কারখানায় পৌঁছে দেয়।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এর পাশাপাশি বাড়ছে শহুরে বর্জ্যের পরিমাণ। এই বর্জ্যকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং রিসাইক্লিং শিল্পে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। ছোট থেকে বড়, সব ধরনের উদ্যোগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ সম্ভব। পুনর্ব্যবহৃত পণ্য, যেমন: গার্মেন্টস শিল্পে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা বা প্লাস্টিক দানা, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

চক্রাকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পণ্যের জীবনচক্র। যেসব পণ্যের জীবনচক্র খুব ছোট (short life cycle), যেমন প্লাস্টিক বোতল বা একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য—এগুলো দ্রুত রিসাইক্লিং চেইনে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে, যেসব পণ্যের জীবনচক্র দীর্ঘ (long life cycle), যেমন আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স বা যানবাহন—সেগুলো মেরামত, পুনঃউৎপাদন বা আপগ্রেড করে বারবার ব্যবহার করা যায়। এই দুই ধরনের জীবনচক্রকেই সঠিকভাবে পরিচালনা করলে চক্রাকার অর্থনীতির সুফল সর্বোচ্চ মাত্রায় পাওয়া সম্ভব।

চক্রাকার অর্থনীতি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশের পরিবেশকে আরও টেকসই করে তুলবে। দূষণ হ্রাস পাবে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সহজ হবে। বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের জন্য বৈদেশিক আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এতে উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।

চক্রাকার অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য শুধু বর্জ্যকে কাজে লাগানো নয়, বরং এটি একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া যা প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। যখন আমরা প্রাকৃতিক সম্পদ কম ব্যবহার করি এবং বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করি, তখন মাটি, জল এবং বায়ুর ওপর চাপ কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, জৈব বর্জ্যকে সার হিসেবে ব্যবহার করলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, যা কৃষি উৎপাদনে সহায়তা করে। এর ফলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস পায়, যা পরিবেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। যদি আমরা প্লাস্টিক বর্জ্য নদী বা সমুদ্রে না ফেলে তা রিসাইক্লিং করি, তাহলে জলজ জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমবে। এটি সরাসরি প্রকৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রক্রিয়া। এই মডেল একটি ইতিবাচক চক্র তৈরি করে, যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং পরিবেশ সুরক্ষা একে অপরের পরিপূরক।

চক্রাকার অর্থনীতির পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, বর্জ্য পৃথকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, এবং এই খাতে বিনিয়োগের স্বল্পতা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সরকারি এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং রিসাইক্লিং শিল্পকে উৎসাহিত করতে সুস্পষ্ট ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। জনগণের মধ্যে বর্জ্য পৃথকীকরণ এবং রিসাইক্লিং সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালাতে হবে। বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে।

রিসাইক্লিং থেকে রাজস্ব আদায় অসম্ভব কিছু নয়, বরং এটি একটি বাস্তব অর্থনৈতিক মডেল, যা বাংলাদেশকে একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। চক্রাকার অর্থনীতির সফল বাস্তবায়ন কেবল অর্থনৈতিক লাভই নিয়ে আসবে না, বরং একটি পরিষ্কার, দূষণমুক্ত এবং বাসযোগ্য পরিবেশও নিশ্চিত করবে।

লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই

ডাকসু নির্বাচনে নতুন সমীকরণ এবং এক অনন্য বার্তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ  (ডাকসু) নির্বাচন মানে রাজনীতির নতুন  সমীকরণ নয় শুধু, নতুন মেরুকরণ

শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা প্রশমন হোক

শিক্ষা জাতির অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন আজ বারবার অস্থিরতায় কাঁপছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়,

আমাদের বাক-স্বাধীনতা

বাক-স্বাধীনতা বলতে কথা বলার স্বাধীনতা সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করাও যাবে,উন্নত বিশ্বে এর বহুল চর্চা রয়েছে

চামড়া শিল্পে বিশ্বজয়ের প্রস্তুতিঃ দরকার প্রযুক্তি ও নীতিগত সহায়তা 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে চামড়া শিল্প একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রধান বিচারপতিও কনটেম্পট অব কোর্টের ঊর্ধ্বে নন: অ্যাটর্নি জেনারেল

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব

দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আরও ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩৬৪ জন

দেশ রক্ষার ক্ষমতা শুধু বিএনপির আছে: শামসুজ্জামান দুদু

আওয়ামী লীগের ক্লিন ইমেজ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেবে জাপা

নির্বাচনে কেউ বিশৃঙ্খলা করলে জনগণকে সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে

আফ্রিকা থেকে সবার আগে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করল মরক্কো

সিলেটের পাথর মহল এলাকাগুলোয় আগে থেকেই পাথর উত্তোলন করা হচ্ছিল

চট্টগ্রামে জশনে জুলুসে পদদলিত হয়ে দুজনের মৃত্যু, আহত ১০

অননুমোদিত সিসা বার পরিচালনার অভিযোগ, সেলিম প্রধানসহ গ্রেপ্তার ৯

প্রথম কাজ হবে ওয়ান বেড ওয়ান স্টুডেন্ট সিস্টেম চালু: আব্দুল কাদের

৫৪ বছরের বাংলাদেশকে দেড় বছরের মুখোমুখি করবেন না: রিজওয়ানা

ডাকসু নির্বাচনে ইসি অপেশাদার আচরণ করছে: সাদিক কায়েম

নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রে অনেকে দিশেহারা: উপদেষ্টা আসিফ

সাংহাই সম্মেলনে ঘনিষ্ঠতা দেখালেও, আসন্ন ব্রিকস সম্মেলনে থাকছেন না মোদি

জাতিসংঘের দূতের কাছে মরক্কোর স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের

রিসাইক্লিং থেকে রেভিনিউ : চক্রাকার অর্থনীতির বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি

চট্টগ্রামে জশনে জুলুসে অংশ নিয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির মৃত্যু

লক্ষ্মীপুরে যাত্রীবাহী বাস খালে ডুবে নিহত বেড়ে ৫ জন

পার্টি অফিসে হামলা-অগ্নিসংযোগ আইনের শাসনের ওপর নগ্ন আঘাত