শিক্ষিত জাতি একটি সমাজের সম্পদ। কিন্তু সেটা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তখন সে সমাজ কখনো একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই শূন্যতাটা বুঝা যায় আমাদের সমাজের নানা স্তরে বুদ্ধিভিত্তিক ও সাংস্কৃতিকসহ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার চিত্র দেখে। অথচ একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা গেলে অন্যসব সমস্যার সমাধান করা একেবারেই সহজ হয়ে যায়। কারণ, সুশিক্ষিত নাগরিক অপরাধ করে কম, বা করেই না। দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মতে, শিক্ষা হলো সবচেয়ে বড় অস্ত্র যা পৃথিবীকে বদলে দিতে ব্যবহার করা যাবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে উপার্জন বৃদ্ধি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যারা শিক্ষার পেছনে বেশি সময় ব্যয় করেছেন গড়পড়তা যারা কম সময় ব্যয় করেছেন তাদের তুলনায় গড় আয় বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে আজকে শিক্ষা ও গবেষণার যে মান তা সহজে অর্জন হয়নি। শিক্ষা ও গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ ছাড়া এ অর্জন সম্ভব হতো না। দেশটির আজকের এ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার পেছনে শিক্ষার বিনিয়োগের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত আংশিক দক্ষ কর্মশক্তিই বাংলাদেশকে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পে কাঠামোগত রূপান্তরে ভালোভাবে সহায়তা করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ২০৩১ অর্থবছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য রেখে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত ও আরো উন্নতির জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশের তথাকথিত মধ্যম আয়ের ফাঁদ অতিক্রম করার জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেখা যায়, যে দেশগুলো শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, তারা দ্রুত মধ্যম আয়ের ফাঁদ এড়াতে সক্ষম হয়েছে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম থাকবে দেশের।
তবে সে পথ যে খুব বেশি মসৃণ হবে না তা প্রতীয়মান হয় শিক্ষার মান ও শিক্ষায় বিনিয়োগের মাত্রা দেখে। শিক্ষার পরিবেশ বিচারে সাক্ষরতার হার আর মানসম্পন্ন শিক্ষা ভিন্ন বিষয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ, ১৯৭১ সালে যা ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে। এ তথ্য জানান দেয় শিক্ষায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হয়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন: শিক্ষায় বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম বারবার পরিবর্তন, এবং একমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার অভাব।ইউনেস্কোর পরামর্শ হচ্ছে, শিক্ষা খাতে একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ এবং বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ বাজেটের ১২ শতাংশের ওপর উঠছে না। এমনকি জিডিপির বিপরীতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে নানা বিষয়ে তাদের মতপার্থক্য রয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কিন্তু একটি জায়গায় তাদের মিল ও তা হলো মানসম্মত শিক্ষায় জোর দেয়া। মানসম্মত শিক্ষার সঙ্গে উন্নয়নের একটা সুসম্পর্ক রয়েছে, তা তাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরিলক্ষিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের পরিকল্পিত শিক্ষা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।এসব দেশের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি।কিন্ত বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম হওয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন হচ্ছে না, তেমনি বেহাল দশা কারিকুলামের। বারবার পরিবর্তন হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম।
অথচ একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় তখনই বিশ্বসেরার তালিকায় নাম লেখাতে পারে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা শক্তিশালী হয়। বিনিয়োগ কম থাকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অনেক পিছিয়ে। দেশের শিক্ষা খাতে সিংহভাগ ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে ব্যয় হয় যৎসামান্যই। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক মানচিত্রে জায়গা করে নিতে প্রয়োজন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও গবেষণাকর্মের অগ্রগতির। বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা বাড়ানো এক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয়। নয়তো চতুর্থ বিপ্লবের যুগে হিমশিম খেতে হবে দেশকে। প্রযুক্তিনির্ভর না হলে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্লথগতি দেখা দেবে। আবার অন্যদিকে মানুষ কর্মচ্যুত হবে। প্রথাগত কাজে মানুষের প্রয়োজন ফুরাবে। কিন্তু কর্মচ্যুত মানুষগুলোকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া সম্ভব কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে। কেননা উৎপাদনের সব উপকরণই নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে। সে অনুযায়ী জনগণকে দক্ষ করতে পারলে দেশে বেকারত্ব চড়াও হয় না বরং মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়; পাশাপাশি মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ে, যা উন্নত দেশ হওয়ার অন্যতম শর্ত। বিশ্বব্যাপীই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল ভালোভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছে।বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছে আরো এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে। ২০৪০ সালে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। তবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা শেষ হবে ২০৫০ সালে। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশই এখন কর্মক্ষম।
এ কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে দরকার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা। এজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে। শুধু সাক্ষরতার হার বাড়ালেই হবে না। মানসম্মত ও কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষের জন্য আনুষ্ঠানিক খাত অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে শিক্ষায় বারবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কারণে আমরা আন্তর্জাতিক মান থেকেও পিছিয়ে পড়ছি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রাথমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত।এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় সব শিক্ষার্থীকে একই বই পড়ানো হয় এবং একই ধরনের শিক্ষা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।তাই একমুখী শিক্ষাক্রম চালুর পাশাপাশি যুগোপযোগী সংস্কার করা ও বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের জায়গায় রাখতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে নতুন স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। সেই জায়গায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। শিক্ষায় বাজেট বাড়ানোর কথা বলা হলে সরকারের তরফ থেকে বারবার অর্থ সংকটের কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে সরকার শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন করতে পারে, যেখানে বিত্তবানরা বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ প্রদান করবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বেশ আগেই এমন উদ্যোগ নিয়েছে এবং সেটি বেশ কার্যকর হয়েছে। দেখা যায় আজকের উন্নত দেশগুলো একসময় টাকা ঋণ নিয়েছে। প্রযুক্তি অনুকরণ করে বা আমদানি করে নিজের দেশের উৎপাদন বাড়িয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। এমনকি শুরুর দিকে তারা বিশেষজ্ঞ আনিয়েছে নিজ নিজ দেশে। ধীরে ধীরে তারা নিজের জনগণকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করেছে। এটি সম্ভব করেছে তাদের মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে। অর্থাৎ কালক্রমে দক্ষ জনবলের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রযুক্তি খাত উন্নত করেছে এবং টাকা, প্রযুক্তি ও জনবলে সমৃদ্ধ হয়েছে।
এ থেকে প্রতীয়মান হয়, শিক্ষায় পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা অতীব জরুরি। বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশে পরিণত হতে চায়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন অভিমুখী দেশের সক্ষমতাও এক্ষেত্রে বিবেচ্য। বর্তমানে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি আবশ্যক। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও মান বিবেচনা করে পৃথক বরাদ্দ দেয়া উচিত এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলনও খুব জরুরি। শিক্ষার্থীরাই জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে কোনো কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি না করলে সেটি জাতির ভবিষ্যৎও তৈরি করবে না।অতিরিক্ত, অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত সিলেবাসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া জিপিএর লোভ থেকে বের হতে হবে। শিক্ষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। যেটি এ দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। এখানে শিক্ষার্থীদের নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যগতভাবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল এলেও এই শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্রের কী কাজে লাগবে তা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই জানে না। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষায় তৈরি হয়েছে চাকরির বাজারের অনিশ্চয়তা। যার দরুণ ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে।আমাদের মনে রাখতে হবে, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষার জন্য কৌশলগুলো হলো- বিজ্ঞান, কারিগরি প্রকৌশল ও গণিত বিষয়গুলোয় মনোযোগ বাড়ানো, সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা, প্রশিক্ষণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি, লিঙ্গ পার্থক্য কমানো এবং গবেষণা ও প্রকাশনায় মনোযোগ বাড়ানো। এ লক্ষ্যগুলো অনুসরণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় এ পুনর্জাগরণকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসন এবং ছাত্রছাত্রীদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসের এ অমোঘ দাবি পূরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ