ই-পেপার বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩১

ড. গোলাম আবু জাকারিয়া : চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার বিশ্ববাঙালি

আবদুল্লাহ আল মোহন:
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৫৫
আপডেট  : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৫৯

বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ক্যান্সার শুধু একজন ব্যক্তির নয়, তার পুরো পরিবারের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও ঘটায়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যান্সার শুধু বাংলাদেশে নয়, এই রোগ বিশ্বে বেড়েছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ক্যান্সার-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ফলে,সুচিকিৎসার কথাটি প্রথমেই চলে আসে। মানুষের শরীরের ক্যান্সারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির ভূমিকার অবদান অনস্বীকার্য। ক্যান্সারের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত সবচেয়ে জরুরি চিকিৎসাপদ্ধতি হলো রেডিওথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি। ক্যান্সার চিকিৎসা জটিল হলেও সময়মতো সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকলে সুস্থ হওয়া সম্ভব। ক্যান্সার প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেতনতার বিকল্প নেই। তবে এর পাশাপাশি পারিবারিকভাবে সচেতন হওয়ার গুরুত্বও অপরিসীম। পারিবারিক সচেতনতা থেকে অনেক ধরনের ক্যান্সারই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ক্যান্সার চিকিৎসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায় রেডিওথেরাপি প্রক্রিয়া নিখুঁত ও কার্যকর করতে পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ করা হয়। বিশেষকরে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে অনেক ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি বেছে নেয়া হয়। আর এই রেডিওথেরাপি বিষয়ে বিশ্বখ্যাতি অর্জন পূর্বক বিশ্বমানব হয়েছেন শাশ্বত অনন্য বাঙালি, বাংলার গৌরবের সারথি জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ হাসপাতাল ক্রেইসক্রানকেনহাস গ্যুমারসবাখ হাসপাতালের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসা পদার্থবিদ বাংলাদেশি-জার্মান অধ্যাপক ড. গোলাম আবু জাকারিয়া। ২০২৪ সালে জার্মান সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ফেডারেল ক্রস অব মেরিট’ পেয়েছেন বাংলাদেশের সন্তান ড.গোলাম আবু জাকারিয়া। জার্মানি এবং বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিন কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননাটি পেলেন এই চিকিৎসা-পদার্থবিদ। উল্লেখ্য আগামী বইমেলায় (ফেব্রুয়ারি ২০২৫) আমার রচিত এই বিশ্বমানবের জীবনীগ্রন্থ ‘চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার বিশ্ববাঙালি গোলাম আবু জাকারিয়া’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে অন্যধারা প্রকাশনী থেকে।

ক্যান্সার চিকিৎসায় ‘আয়নাইজেশন চেম্বার’-এর জনক জার্মানপ্রবাসী ড. জাকারিয়ার হাত ধরেই বাংলাদেশে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা বিষয়টি শুরু হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায়ও রয়েছে তাঁর ভূমিকা। তিনি জার্মানিতে বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য ২০১৩ সালে পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমি প্রবাসী লেখক পুরস্কার’। ড. জাকারিয়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে জার্মানি যান। সেসময় তিনি চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহী হন। জার্মানিতে তখন বিষয়টি নতুন। ফলে তাঁকে এই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। একসময় সফল হন জাকারিয়া। তবে শুধু জার্মানিতে এই বিষয়ে চাকরি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি,বাংলাদেশের সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়েও চালু করেছেন চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা বিভাগ। তিনি চান, তাঁর মাতৃভূমিতে ক্যান্সার নিরাময়ে রেডিওথেরাপির ব্যবহার সহজলভ্য হোক। বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিক্সের পথিকৃৎ অধ্যাপক ড.গোলাম আবু জাকারিয়া বিশ্বের বিভিন্ন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের সাথে দলবদ্ধভাবে দেশের পক্ষে কাজ করছেন। তিনি জার্মানিতে নিজের কেরিয়ার গড়ার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যকে জার্মানদের কাছে পরিচিত করণে নানা উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন । তাছাড়া, একজন দেশপ্রেমী মানুষ হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র’ একাধিক বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের ওপর জার্মান ভাষায় বই প্রকাশ করেছে। জার্মানিতে ‘বাংলাদেশ স্টাডি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার- বিএসইজেড’ নামের এনজিওটি সারা বছর বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করছে। জার্মানিতেও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সহানুভূতি রয়েছে। এছাড়া,তিনি বাংলাদেশে একাধিক স্কুল ও চিকিৎসালয়ও গড়ে তুলেছেন । দেশপ্রেমী এই মানুষটির অবসর সময় কাটে মানবসেবায়। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে বসবাস করছেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে।

গোলাম আবু জাকারিয়া ১৯৫৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর নওগাঁ জেলার ইকরকুড়ি গ্রামে জন্মেছেন। বাবা বনিজ উদ্দীন প্রামাণিক ও মা রহিমা বেগম। ১৯৬৮ সালে কেডি হাইস্কুল থেকে মেট্রিকে রাজশাহী বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দশম এবং ১৯৭০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। শৈশব থেকে তাঁর প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। এরপর তিনি মেধার জোরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হলেন। তিনি তড়িৎ ও তড়িৎ কৌশল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলেন। তৎকালীন কায়েদে আজম (এখন তিতুমীর) হলে উঠলেন। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রথম বর্ষের ছাত্র জাকারিয়া চট্টগ্রামের বালুরঘাটে চলে যান। তিনি সীমান্ত এলাকায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মায়ের কারণে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের বদলে শরণার্থী ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দেশের প্রতি দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পৌঁছে দেওয়াসহ নানা রকমের ভূমিকা পালন করেছেন। অবশেষে দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পর তিনি বুয়েটে ফিরে এলেন। মনপ্রাণ দিয়ে পড়ালেখা শুরু করলেন। তিনি অকৃত্রিম আন্তরিকতায় নতুন স্বপ্ন নিয়ে দেশ পুনর্গঠনে কাজ শুরু করলেন।

১৯৭৩ সালে গোলাম আবু জাকারিয়ার জীবন বদলে যায়। তৎকালীন বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সব হারানো বাঙালিকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য উচ্চতর শিক্ষাবৃত্তি দিতে লাগল। তেমনই জার্মানি সাহায্যের অংশ হিসেবে বাংলাদেশি ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান করে। জাকারিয়া ছিলেন প্রথমদিকে এ বৃত্তি প্রাপ্তদের অন্যতম একজন। বৃত্তি নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি জার্মানিতে চলে যান। তিনি বাংলাদেশ থেকে উচ্চতর শিক্ষা নিতে যাওয়া প্রথম ব্যাচের ছাত্র। বিদেশে যাওয়ার আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের আমন্ত্রণ পেলেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন তাদেরকে বললেন, ‘তোরা যেখানে যাস যা। তবে মনে রাখিস, তোরা বাংলাদেশের গরিব মানুষের পয়সা দিয়ে এখানে পড়ালেখা করেছিস, তাদের ভুলিস না মোটেই।’ কথাগুলো দারুণভাবে তাঁকে নাড়া দেয়। তাঁর জীবনে বারবার সত্য-সাধনার বীজমন্ত্র হয়ে ওঠে জাতির পিতার দিক-নির্দেশনা। আর এই মানবিক আহবানই বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁকে সারাজীবন কাজ করতে প্রাণিত করছে।

তিনি জার্মানিতে ‘মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটি হালে উইটেনবার্গ’-এ ভর্তি হলেন। বিষয় ‘পদার্থবিদ্যা’। নিয়মিত ক্লাস, লেখাপড়া ও গবেষণায় তাঁর জীবন কাটতে লাগল। বিজ্ঞানী কিংবা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন মনে বুনছেন। তাঁর জীবন বদলে গেল আরেক বক্তব্যে। নোবেলজয়ী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ম্যাক্স ডেলবুর্ক একটি সেমিনারে পদার্থবিদদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিশ্বে দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। অনেক রক্তারক্তি হয়েছে। পদার্থবিদদের উচিত, পরমাণু বোমা তৈরির কাজ বাদ দিয়ে চিকিৎসা পদার্থ নিয়ে কাজ করা। এতে অনেক মানুষ উপকৃত হবে।’ সেদিন ‘আনবিক জীববিদ্যা গবেষণা প্রকল্প’র এই অন্যতম উদ্ভাবক তরুণ ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও শিক্ষকদের আরো বলেছিলেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানীদের যুদ্ধ করার জন্য পরমাণু বোমা বানানোর গবেষণা বাদ দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে চিকিৎসায় পদার্থবিদ্যার গবেষণা শুরু করা প্রয়োজন।’ তাঁর এ কথাই জাকারিয়ার জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার ওপর কিছু করার ভাবনা তাঁকে দারুণভাবে পেয়ে বসে। জাকারিয়া নতুন আলোর ঠিকানা খুঁজে পেলেন। তবে শুরুতে মোটেই এই পথ চলা এতটা সহজ ছিলো না। ১৯৭৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স পাস করলেন। এরপর এমএসসি করলেন। চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞানে থিসিস করতে চাইলেন। এত ভালো ছাত্রের অনুরোধ রাখতে অসুবিধা হলো না শিক্ষকের। তার আগ্রহ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ মার্টিন লুথার ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সেন্টারে তাকে আলাদা গবেষণার সুযোগ করে দিলেন। তিনি রোগী ও চিকিৎসকদের সাহায্যে কাজ শুরু করলেন। তিনিই প্রথম মানুষ যিনি আয়নাইজেশন চেম্বার বাণিজ্যিকভাবে জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের জন্য তৈরি করেন। তার আগে এটি বিজ্ঞানী মার্কুস তৈরি করেছিলেন।

তিনি ১৯৮০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ও স্নাতক-উত্তর চিকিৎসা পদার্থবিজ্ঞানের ভুবনে প্রবেশ করলেন। এরপর বিশ্বখ্যাত গবেষণা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হেইডেলবার্গ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয়, ‘ট্রিটমেন্ট প্ল্যানিং সিস্টেম (টিপিএস) ইন রেডিওথেরাপি’। তিনি ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপি যন্ত্রের কম্পিউটার সফটওয়্যার নিয়ে উন্নততর গবেষণা করলেন। ১৯৮৬ সালে অর্জিত তাঁর এই পিএইচডিকে আজও অতি উচ্চমানের এবং প্রথম শ্রেণির পিএইচডি ডিগ্রি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপর তিনি জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত গার্মেসবার্গ হাসপাতালে, প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা পদে কর্মজীবন শুরু করেন। পেশা জীবন বর্হিভূত সমাজসেবায়ও নিজেকে ড. আবু গোলাম জাকারিয়া ব্যাপৃত রেখেছেন। তিনি জার্মানির চিকিৎসা-পদার্থবিদ সমিতির ‘উন্নয়নশীল বিশ্বে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা’ কার্যকর দলের চেয়ারম্যান। তাঁরা তানজানিয়া, নিকারাগুয়া ও বাংলাদেশে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা বিভাগ চালুর জন্য তারা কয়েক বছর সেমিনার করেছেন। তবে আমলাতন্ত্র তাঁদের কাজকে গতিশীল করণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেনি, সংশ্লিষ্টরা মৌলিক বিষয়গুলোই অনুধাবন করতে পারেনি। স্বপ্নবীজকে মহীরুহতে পরিণত করতে মোটেই দমানোর মানুষ নন তিনি। তাই বিকল্প পথ অনুসন্ধানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মাধ্যমে ২০০০ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং’ চালু করেন। তিনি এই বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মূল ভূমিকা পালন করেন। তিনি বছরে তিন-চারবার সেমিস্টারের ছুটিতে বাংলাদেশে এসে নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি জীবচিকিৎসা প্রকৌশল বিষয়ও পড়ান। এখন বিভাগটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। নামকরণ করা হয়েছে ‘ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং’। এটিই এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র বিভাগ। এখানে শুরু থেকে ক্যান্সার চিকিৎসায় দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি তিনি ‘আলো ভুবন ট্রাস্ট’ গড়েছেন। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে তারা সমাজহিতকর কাজ করেন। পাশাপাশি তাঁদের ‘সাউথ এশিয়ান সেন্টার ফর মেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড ক্যান্সার রিসার্চ’ আছে। এটির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্যান্সার চিকিৎসায় দক্ষ চিকিৎসা পদার্থবিদ তৈরি করতে সচেষ্ট রয়েছে। ১৯৯৯ সালে নওগাঁয় তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বপ্নের পাঠশালা ‘ইকরকুঁড়ি উচ্চ বিদ্যালয়’ পুরোদমে চালু আছে। ২০০০ সালে নিজ জেলায় ‘মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র’ চালু করেছেন। কেন্দ্রটির অধীনে নওগাঁ সদর উপজেলার ১৭ টি ইউনিয়নে ‘মোবাইল ক্লিনিক’ চালু আছে। ক্লিনিকটি মাসে একবার এক ইউনিয়নে যায়। সৌরবিদ্যুতের আলোয় চিকিৎসা দেন, চিকিৎসকরা অপারেশন করেন। ড. গোলাম আবু জাকারিয়ার এই মানবিক ও মহতী অলাভজনক কাজগুলোর একটিমাত্রই উদ্দেশ্য- একজন মানুষকেও তিনি বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে মরতে দিতে চান না।

স্বদেশের প্রতি মমতার কারণেই চিকিৎসা পদার্থবিদ্যায় ভালো কর্মক্ষেত্র তৈরির পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে বিদেশেই থাকতে হবে। কাজের প্রয়োজনে বিদেশে অবস্থান করেও তিনি মা, মাতৃভূমিকে মোটেই ভোলেননি। আর তাইতো নানা উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে তিনি জার্মানিতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্য বিষয় প্রসারণে তিনি কয়েকজন সদস্য সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ স্টাডি অ্যান্ড ডেভেলপিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাঙালি, জার্মানরা এর নিয়মিত সদস্য। জার্মানদের কাছে অচেনা নজরুলকে চেনানোর জন্য ১৯৯৯ সালে তাঁর কবিতা, গানের ওপর তিনি জার্মান ভাষায় প্রামাণ্যগ্রন্থ লিখেছেন, ‘লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক অব বেঙ্গলি পয়েট কাজী নজরুল ইসলাম।’ এটিই জাতীয় কবির ওপর বিদেশি ভাষায় লেখা প্রথম বই, ফ্রাঙ্কফুর্টের ‘ইন্টারকালচারাল পাবলিকেশন’ বইটি প্রকাশ করেছে। খুব সমাদৃত হয়েছে। এই সেন্টার থেকে ২০০১ সালে তাঁর সম্পাদনায় ‘বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশ’ গবেষণা জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে তিনি জার্মান ভাষায় ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন : পোর্ট্রেট অব আ বেঙ্গলি ফিমেল রাইটার’, ২০১১ সালে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ওয়ান্ডারার বিটুইন ওয়ার্ল্ডস’ লিখেছেন। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তিনি সম্পাদিত গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। জার্মান ভাষায় বাংলাদেশকে তুলে ধরে বিদেশি ভাষায় বাংলাদেশ চর্চার জন্য ২০১৩ সালে তাঁকে বাংলা একাডেমি ‘প্রবাসী লেখক পুরস্কার’-এ সম্মানিত করেছে। তিনি ২০১১ সালে নিজের পতিসর উপজেলায় রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছেন। তাঁরই উদ্যোগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য নওগাঁর রবিতীর্থ পতিসরে ‘রবীন্দ্র ক্যানসার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। পতিসরে ‘আলোর ভুবন কল্যাণ ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ড. গোলাম আবু জাকারিয়া ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বাঙ্গীন দায়িত্ব পালন করছেন। পতিসরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নামে ‘ক্যান্সার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেছেন, যার ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্যান্সার চিকিৎসার পথ সুগম হবে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার চিহ্নিতকরণ ও রোগীর সুচিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণাও করা যাবে। এই মুক্তিযোদ্ধার বাংলাদেশ সম্পর্কে বিপুল প্রত্যাশার সাথে রয়েছে দায়িত্ব পালনের আন্তরিক প্রচেষ্টা। তিনি দেশের প্রত্যাশার বিষয়ে বলেছেন, ‘আমি দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতি খুব বেশি আশাবাদী। তাদের মধ্যে কোনো বিষয় ছড়িয়ে দিতে পারলে সহজে সাফল্য আসবে।’ তাঁর স্বপ্ন- বাংলাদেশের কোনো মানুষ চিকিৎসার অভাবে ক্যান্সার রোগে মারা যাবে না। তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

মহান এই দেশপ্রেমী সম্পর্কে প্রকাশিত ‘অনুরাগীদের স্মৃতিকথায় অধ্যাপক জাকারিয়া, বাংলাদেশের মেডিকেল ফিজিক্সের পথিকৃৎ’ স্মৃতিকথা গ্রন্থটির দিকে এবার একটু নজর দেওয়া যাক। মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত শ্রম, সময় ও জ্ঞানদানকারী ব্যক্তি দেশ তথা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘অনুরাগীদের স্মৃতিকথায় অধ্যাপক জাকারিয়া, বাংলাদেশের মেডিকেল ফিজিক্সের পথিকৃৎ’ গ্রন্থটি এমন একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ও পাঠকের মধ্যকার যোগসূত্র বিশেষ। তিনি মেডিকেল ফিজিক্সশাস্ত্র বিকাশের পথ প্রশস্ত করেন। বিশ শতকের নব্বই দশকে বাংলাদেশের মেডিকেল ফিজিক্স ছিল নতুন বিষয়। সহকর্মীদের সহযোগিতা এবং জার্মান সরকারের আর্থিক বৃত্তির সহায়তায় বাংলাদেশ ক্যান্সার চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণপূর্বক তিনি এই শাস্ত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণে সক্ষম হন। ‘অনুরাগীদের স্মৃতিকথায় অধ্যাপক জাকারিয়া’ গ্রন্থে তিনটি ভাগে ৩১টি নিবন্ধ সংকলিত হয়েছে। আলোচ্য স্মৃতিগ্রন্থে প্রখ্যাত ডাক্তার, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও তাঁর বন্ধুবান্ধবসহ অনেকেরই ড.জাকারিয়া সংশ্লিষ্ট নানা স্মৃতি রয়েছে। প্রত্যেক লেখকই মুক্তমনে স্ব-স্ব অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। এসব বিবেচনায় বইটি বৈচিত্র্যময়। অনুসন্ধিৎসু গবেষক ও পাঠকের জন্য বাংলাদেশে শাস্ত্ররূপে মেডিকেল ফিজিক্সের সূচনা এবং প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানার অভিজ্ঞতা হবে- এ ধারণা অমূলক নয়। তাছাড়া, ড.জাকারিয়ার বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা জানা-অজানা কর্মের বর্ণনা গ্রন্থটিতে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। গ্রন্থটির লেখকদের ধন্যবাদ জানাই। গ্রন্থটি তরুণ প্রজন্মের জন্য নির্দেশিকাস্বরূপ। আলোচ্য গ্রন্থটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সেতুবন্ধনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা লাভে সক্ষম হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাচ্ছেন,কেউ সেখানে স্থায়ী হচ্ছেন,অধ্যাপক জাকারিয়ার জীবন ও কর্ম তাদের প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করবে। অধ্যাপক জাকারিয়ার মতো বিশ্বমানব হতে গেলে সর্বান্তকরণে শাশ্বত বাঙালিও হতে হবে,এটা যেন কখনোই ভুলে না যাই স্মৃতিকথা গ্রন্থটির প্রতিটি রচনাই তেমনই দিক-নির্দেশনা দেয়। আলোর ঠিকানা হিসেবে সকলকে সঠিক পথের দিশা দেখাবে বলেই গভীর প্রতয় জন্মে স্মৃতিকথা গ্রন্থটির রচনাগুলো পাঠকালে।

(সূত্র:‘অনুরাগীদের স্মৃতিকথায় অধ্যাপক জাকারিয়া, বাংলাদেশের মেডিকেল ফিজিক্সের পথিকৃৎ’, প্রকাশক: আলো ভুবন ট্রাস্ট এবং প্রকাশিতব্য ‘চিকিৎসা পদার্থবিদ্যার বিশ্ববাঙালি গোলাম আবু জাকারিয়া’ : আবদুল্লাহ আল মোহন, প্রকাশক: অন্যধারা।)

লেখক : আবদুল্লাহ আল মোহন, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।

আমার বার্তা/এমই

বিদায়ী বছরের ইতিবৃত্ত ও নতুন বছরের সূচনা

ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে পেরোতে থাকে সময়। সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টার হিসাব রূপান্তরিত হয় দিন-মাস-বছরে। সূর্যোদয় এবং

অসৎ, অতিরিক্ত লোভী এবং পরশ্রীকাতর, সমাজের জন্য অদৃশ্য ক্ষতির উৎস

মানবজীবনে নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু অসৎ মনোভাব, অতিরিক্ত লোভ, এবং পরশ্রীকাতরতা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে

প্রশাসনিক সংকট ও ভবিষ্যতের করণীয়: একটি সুষম বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা, যা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন হিসেবে

আপনার বৃদ্ধকালের সঙ্গী হিসেবে সন্তানকে গড়ে তুলুন

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আপনার সন্তানই আপনার বৃদ্ধ বয়সের সঙ্গী, তাই সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই প্রয়োজন

পুলিশের তিন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে বাধ্যতামূলক অবসর

সরকারি কর্মচারীদের দ্বৈত নাগরিকত্বের তথ্য চেয়ে তিন দপ্তরে চিঠি

বছরজুড়ে ডেঙ্গুতে ৫৭৫ মৃত্যু, শনাক্ত লাখের বেশি

১৪ দিনে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র অসম্ভব নয়: রিজওয়ানা

দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে হবে: ফখরুল

যুক্তরাষ্ট্রে নববর্ষ উদযাপনের সময় ভিড়ের মাঝে গাড়িচাপায় নিহত ১০

প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট সরকার, শতভাগ নিশ্চিত হতে নমুনা পরীক্ষা বিদেশে

হাসিনাকে ফেরতসহ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেব

শহীদ মিনারে দেওয়া বক্তব্য জাতীয় ঐকমত্যে বাধা হতে পারে

স্ত্রীসহ সাবেক ডিএমপি কমিশনার ফারুকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

রাজধানীতে অটোরিকশা চালককে কুপিয়ে হত‍্যা

বেক্সিমকোর তিন প্রতিষ্ঠানে নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ বিএসইসির

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের রেকর্ড গড়ল ডিসেম্বর

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও চার প্রসিকিউটর নিয়োগ

ডিএমপিতে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার ৭ কর্মকর্তার পদায়ন

ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করতে চায় না বিএনপি: আমীর খসরু

ছাত্রদলের বর্ণাঢ্য র‍্যালি

সব দ‌লের মতামত না নি‌লে সংস্কার টেকসই হ‌বে না: জিএম কা‌দের

তিন মামলায় ব্যারিস্টার সুমনের জামিন নামঞ্জুর