কয়েকদিনের নাটকীয় উত্তেজনাকর ঘটনার পর অবশেষে পাকিস্তানের সাথে ইরানের উত্তেজনার পারদ কমার আশা দেখা যাচ্ছে। এতে আপাতত শান্তি আসতে পারে। দুই দেশের উত্তেজনা নিয়ে যে আঞ্চলিক শক্তিমত্তা দেখানোর টেনশন বা যুদ্ধ চিন্তা শুরু হয়েছিল আপাতত তা থেকে মুক্তি পাচ্ছে পৃথিবী। ইরান ও পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ‘ইতিবাচক’ বার্তা আদান-প্রদান করেছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। এই বার্তা বিনিময় দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা শীতল হওয়ার বিষয়টিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মমতাজ জাহরা বালোচ তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব রহিম হায়াত কোরেশি এবং ইরানের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র সৈয়দ রাসুল মুসাভির সঙ্গে আলোচনা করে বলেছেন, ‘ইতিবাচক বার্তা বিনিময়’ হয়েছে।
বিশ্ব যখন ইসরায়েল-গাজা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উত্তপ্ত, এইসময় নতুন করেন ইরান-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে ১৬ই জানুয়ারি। সেদিন রাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের সীমান্তবর্তী এক শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইরান। সেই হামলায় পাকিস্তানে দুই শিশুর মৃত্যু এবং তিনজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। ইরানের দাবি, পাকিস্তান ভিত্তিক সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করেই তারা এই হামলা চালিয়েছে। এই গোষ্ঠীটি পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে সক্রিয়, যারা সবসময় ইরানের সরকারের বিরোধিতা করে। ঐ হামলার দু’দিন পর, অর্থাৎ গত ১৮ই জানুয়ারি নিজেদের ভূ-খণ্ডে ইরানের হামলার বিপরীতে দেশটিতে 'প্রতিশোধমূলক' পাল্টা রকেট ও ড্রোন হামলা হামলা চালায় পাকিস্তান। ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানা লক্ষ্য করে চালানো হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়। এই পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পরা নিয়ে বিশ্ব শঙ্কিত হয়ে পরে। কারণ এ ধরনের ঘটনা থেকেও যুদ্ধে জড়িয়ে পরার ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া দুই দেশেই সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী। পাকিস্তানের কাছে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র। তাছাড়া এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব যুদ্ধের ভারে ক্লান্ত। বহুরৈখিক সমস্যার জন্ম হয়েছে এই যুদ্ধে। ইসরাইলের গাঁজায় সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে সেই সমস্যা আরও বেশি ঘনিভূত হয়েছে।
ইসরাইলের বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ২৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। হামাস নির্মুলের নামে যে অভিযান পরিচালনা করছে তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। এর বিচার গড়িয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত। তাতেও ইসরাইল দমেনি বা যুদ্ধ বন্ধের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। হামাস সম্পূর্ণরুপে শেষ না হওয়া পর্যন্ত (ইসরাইলের ভাষায়) সম্ভবত এ অভিযান তারা থামাবে না। এতে যে কত হাজার হাজার নিরীহ নারী-শিশু নিহত হচ্ছে তা হিসাব নেই। পরিসংখ্যান আর কতক্ষণ যন্ত্রণার হিসাব করতে পারে। এরই মাঝে ক্ষুধা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে গাঁজাবাসীর জন্য। হামাস- ইসরাইলের এই সংঘাত এখন আর শুধু হামাস-ইসরাইলের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি ছড়িয়ে পরছে। স্থল থেকে এটি এখন লোহিত সাগরেও বিস্তৃত হয়েছে। তাছড়া হিজবুল্লাহ যোদ্ধারাও লড়াই করছে। তারা ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে রকেট ছুড়ছেন। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে লেবাননের বিভিন্ন স্থানে। ইসরায়েলের হামলায় লেবাননের বৈরুতে প্রাণ হারিয়েছেন হামাসের উপপ্রধান সালেহ আল-আরৌরি। ইসরায়েলের এই আগ্রাসন বন্ধে ইয়েমেনের হুতিরা লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হামলা চালানো শুরু করে। মাঝে মধ্যেই তারা এই হামলা করছে। এই হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্রও বসে নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইয়েমেনে হুথিদের লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। হুথিদের হামলার ভয়ে লোহিত সাগরের এই রুটে জাহাজ চলাচল আগের চেয়ে কমেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে পণ্য পরিবহনে বিকল্প পথ বেছে নিতে হচ্ছে। এর ফলে বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে। যা বৈশ্বিক বাজারকে প্রভাবিত করছে। তাছাড়া বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশকে ভাবাচ্ছে।
একটি যুদ্ধ কীভাবে বৈশ্বিক রুপ নিতে পারে তার রুপ দেখছে বিশ্ববাসী। যদিও এখনই এটা বলার সময় আসেনি যে এটি শেষ পর্যন্ত আরও বিস্তৃত হবে। তবে ইসরাইলের এ নির্মম অভিযান অব্যাহত থাকলে তা ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনাই বেশি। মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে পরলে তার আগুন থেকে কোনো মহাদেশই ছাড় পাবে না। কারণ জ্বালানী তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী মধ্যপ্রাচ্য। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ করা গোয়েন্দা তথ্যে জানানো হয়েছে, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলায় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ইরানের। ওদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সাথে ইরানের সম্পর্ক ভালো হলেও দুই দেশের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। এই যুদ্ধের ভারে ঢাকা পরেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অথচ সেখানেও যুদ্ধ চলছে। তবে ইসরাইলের ফিলিস্তিনের প্রতি এই মাত্রা অতীতের সব ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেছে। গাঁজায় ইসরাইলের আগ্রাসনের ১০০ দিন পার হয়েছে। এই ১০০ দিনে গাঁজা প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। শহরটি আজ মৃত। ব্যাপক আকারে ক্ষুধা ও অনাহারে ভুগছেন পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনি। গাজার ৬৯ শতাংশেরও বেশি স্কুল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরাইলি আগ্রাসনে এখন পর্যš ১৮ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরাইলের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত থেকে দুই লাখ ৪৯ হাজার ২৬৩ ইসরাইলি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পশ্চিম তীর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এক হাজার ২০৮ ফিলিস্তিনি। হুথিদের দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হামলা করে কি যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে? সামনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। এখনই তাদের এ ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পরার সম্ভবনা কমই। কিন্তু পাল্টাপাল্টি এই হামলা অব্যাহত থাকলে কি ঘটবে তা বলা যায় না। কারণ লোহিত সাগর বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য এবং সেই পরিবর্তন মানব সভ্যতার জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না।
যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দাভাবে বড় অর্থনীতির দেশগুলোরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যুদ্ধ পৃথিবীকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দেয়নি এবং বর্তমানে যে অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে সেখানেও যুদ্ধ কিছুই দিতে পারেনি। পৃথিবীতে যে একটি সাম্যতা ও ন্যায়ের লক্ষ্য ছিল এবং তার ভিত্তিতে আদর্শিকভাবে একটি দারিদ্রতামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা তা যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে বিনষ্ট হয়েছে। দেশের মধ্যেই অন্তর্দ্বন্দ্ব সেই দেশকে বহুমুখী সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যুদ্ধ আসলে মানব সভ্যতাকে কোনোদিনই ভালো কিছু দিতে পারেনি। যা দিয়েছে তা হলো মানবিক যন্ত্রণা যা দীর্ঘমেয়াদে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ভোগ করছে। দিয়েছে অশান্তি যার আগুনে পুড়েছে পুরো মানব সভ্যতা। অসংখ্য মানুষ তাদের বাস্তুচুত্য হয়েছে। তারা আজ আশ্রয়হীন হয়ে পরাধীন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ তাদের দায় কেউ নিচ্ছে না। বৈশি^ক ক্ষমতায়নের একটি নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। একক ক্ষমতায়নের সময়কাল থেকে বেরিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র ব্যবস্থার পালাবদল ঘটার ইঙ্গিত দিতে চলেছে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা পৃথিবীতে নতুন নয় কিন্তু যুদ্ধের ফলে পৃথিবীজুড়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার অভিজ্ঞতা একটু নতুনই বলতে হবে। শেষ পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে যা বিশ্ববাসীকে শঙ্কিত করে তুলছে। কারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনও নড়বড়ে। জ্বালানি নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অশান্তি ছড়িয়ে পরলে বা এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের পারমাণবিক ইস্যু সামনে এলে অথবা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পরলে বিশ্ব একটি সর্বাত্বক ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি হতে পারে। সে কারণেই ইরানের সাথে পাকিস্তানের উত্তেজনা প্রশমনের খবর স্বস্তিদায়ক। কোনো যুদ্ধের উত্তেজনাই বৃদ্ধি পাওয়ার আগে মিটিয়ে ফেলা দরকার। কারণ বিশ্ব যুদ্ধ নয় শান্তি চায়।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা।
আমার বার্তা/অলোক আচার/এমই