২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তারেক রহমান। দেশে ফিরতে মানা, কথা বলতে মানা, কথা প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও এগিয়েছেন। তার দৃঢ়তায় নির্যাতকদের পরাস্ত হতে হয়েছে নিদারুণভাবে। চব্বিশের বিপ্লব-পরবর্তী স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেতেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। একজন নির্যাতিত হিসেবে প্রতিহিংসাপরায়ণ ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার শঙ্কা করেছেন অনেকে, বাস্তবে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র।সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন শান্ত থাকার। বিগত সরকারের অবিরাম অপপ্রচার, পতিত প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েক মন্ত্রীর নিয়মিত গালমন্দ, ভেংচি, খিঁচুনির জবাব কখনো মন্দ কথায় দেননি তারেক রহমান। তার কাজ তিনি করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে, যা ক্রমে তাকে আরো শক্তিশালী করেছে। খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তোলার শক্তি দেখিয়েছে। দলের তৃণমূলের কাছে হয়ে উঠেছেন ছায়াসঙ্গী। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দলীয় লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গুম হয়েছেন ৫০০-এর বেশি। হত্যার শিকার হয়েছেন অসংখ্য। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বহু নেতাকর্মী। হামলা-মামলা, জীবিকা, ব্যবসাবাণিজ্য খুইয়ে পথে বসেছেন বিপুলসংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে অসহায়ের মতো দিনাতিপাত করেছে গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলো। তাদের সবার সাথে নিজে একটি সেতুবন্ধ গড়েছেন তারেক রহমান। পরিবারগুলোর খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে তৈরি হওয়া নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে নিজ দলকে সামলিয়েছেন কঠোর নির্দেশনায়। দ্য উইক ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি ভাঙার চেষ্টার বিপরীতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে, যা দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিবর্তন তারেক রহমানকে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হতে পারে তারেক রহমানের জন্য। ওয়ান ইলেভেন জমানায় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেফতার করা হয় তারেক রহমানকে।গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। আর রচনা করা হয় বদনাম-কলঙ্ক। ১৮ মাস কারান্তরীণ থাকার পর জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশ ছাড়েন ব্রিটেনের উদ্দেশে। সেই থেকে এখনো লন্ডনে আছেন। সেখান থেকে দল পরিচালনা করছেন। পতিত স্বৈরাচারের পক্ষ থেকে একেক সময় দলটি ভেঙে টুকরো টুকরো করার আয়োজন হয়। এসব নোংরামিতে দল ভাঙেনি; বরং হয়েছে আরো টেকসই-সংগঠিত। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি যা হারিয়েছেন, তা ফেরত পাওয়ার নয়। অন্যদিকে, তার স্ত্রী ডা: জুবাইদা রহমানও স্বামীর সাথে এই পুরো সময় নির্যাতন হজম করেছেন। কেবল তারেক রহমানের স্ত্রী হওয়ায় ডা: জুবাইদাকে হেন অপদস্ত নেই, যা না করেনি হাসিনা সরকার। ডা: জুবাইদা বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের অত্যন্ত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী। তার পরীক্ষার ফল চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ঈর্ষণীয় বিষয়। সেই তাকে শুধু চাকরিচ্যুত নয়, মামলা-মোকদ্দমায় জড়ানো হয়। এমন কঠিন সময়েও টলেননি, ভাঙেননি তারেক রহমান। লন্ডনের নির্বাসন তাকে করেছে অপ্রতি রোধ্য, দেশের মিডিয়া তার বক্তব্য প্রচার করতে না পারলেও ভিডিও কনফারেন্স, সোস্যাল মিডিয়া ও আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে দেশের আনাচে-কানাচে তৃণমূল থেকে জাতীয় পরিসরে আরো দীপ্তমান করেছে। দলীয় নেতাকর্মীকে করেছে আরো যূথবদ্ধ।তারেক জিয়া তার মা বেগম খালেদা জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন উল্লেখ করে দ্য উইক ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার পদচ্যুত হওয়ার পর বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে। যিনি ভার্চুয়ালি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন, ঢাকায় নামার পর তার জীবনে পূর্ণচক্র সম্পূর্ণ হবে।
খালেদা জিয়া আশা করছেন, তারেক রহমান আসন্ন নির্বাচনে দলের মুখ হিসেবে আবির্ভূত হবেন। তারেক রহমান ইতোমধ্যে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে রেখেছেন। চাকরি, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষক, শ্রমিক বা শ্রমজীবী যেই হোন না কেন, তাদের সমান সুযোগ, ন্যায্য মজুরি এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিতে চান তিনি। পাশাপাশি একটি জ্ঞানভিত্তিক ও উন্নয়ন কেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে তুলতে তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে কাজ চলছে। সব নজর এখন থাকবে এ দিকে যে, কতটা দক্ষতার সাথে বাংলাদেশের নেতৃত্ব নিতে সক্ষম হবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিগত সেনা-সমর্থিত সরকার তারেক রহমানকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা হাসিনা আমলেও বহান ছিল। একই সাথে সামরিক- প্রশাসনিক কর্তৃত্ব তার কাছ থেকে লিখিত অঙ্গীকার নিয়েছিল যে, তিনি ভবিষ্যতে আর রাজনীতি করবেন না। এটি ছিল তার রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি চরম লঙ্ঘন। বহু আইনি ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তিনি। ২০০৯ সালে দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে হন পুনঃনির্বাচিত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় মায়ের কারাবরণের পর থেকে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কঠিনেরে জয় করে আরো কঠিনের পথে তিনি। আগামী নির্বাচন হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষা। এ বার্তা দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে রেখেছেন তিনি আরো আগে। তবে সবার কাছে তা বোধগম্য হয়নি। যারা যদ্দুর পেরেছেন বুঝেছেন। দলের ভেতর-বাইরেসহ গোটা রাজনীতিতে যে উচ্চতায় এখন তার অবস্থান,সাথে কঠিন দায়িত্বও বটে।কিন্ত অযাচিত সমালোচনা-অতিরঞ্জিত অপপ্রচার সত্যেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান টিকে আছেন সগৌরবে। তার বিরুদ্ধে হাসিনা ও তার দোসররা সীমাহীন গুজব রটিয়েছে। এরপরও ১৭-১৮ বছর ধরে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ওয়ান ইলেভেনের দু’বছর এবং আওয়ামী লীগ আমলের ১৫-১৬ বছর কখনো কখনো দল ভাঙার উপক্রম ঠেকিয়েছেন সুদূর ব্রিটেন থেকে। দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে এখন নিচ্ছেন কঠোর পদক্ষেপ। দলের সব স্তরে অভিযোগদৃষ্টে বহিষ্কার, পদাবনতি, পদ স্থগিত, শোকজসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলে যাচ্ছেন মানুষ অপছন্দ করে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে।আওয়ামী লীগের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বানও জানিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। দুই দশক ধরে বহু সঙ্কট মোকাবেলা করে এগিয়েছেন তিনি। যে কারণে হাসিনা তাকে সহ্য করতে পারেননি। যার প্রকাশ চাপা রাখতে পারেননি তিনি। প্রসঙ্গ ছাড়াও তারেক রহমানের নাম উচ্চারণ করতেন। অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেছেন প্রতিনিয়ত। তুই-তুকারিসহ নিম্নমানের ভাষায় আক্রমণ করেছেন অসংখ্যবার। শেখ হাসিনার ওই সব অশালীন ভাষার কখনো কোনো জবাব দেননি তারেক রহমান। দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক হওয়ায় এখন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলো, বিএনপি। ইন্টারিম সরকারও এটা বোঝে এবং সেই অনুযায়ী বিএনপিকে যথাযথ গুরুত্বও দেওয়া হচ্ছে। ভোটের রাজনীতিতে কার মনে কী লুকিয়ে আছে সেটি বলা মুশকিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত প্রভৃতি দল মোট প্রদত্ত ভোটের যে কয় শতাংশ পেয়েছিল আজকের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সেই শতাংশ আর খাটবে না। এখন প্রদত্ত ভোটের রেখাচিত্র বদলে যাবে। আগামী নির্বাচনে কোন দল কত শতাংশ ভোট পাবে সে সম্পর্কে অগ্রিম পূর্বাভাস এই মুহূর্তে দেওয়া সমীচিন হবে না। তবে বিএনপি যেহেতু এই মুহূর্তে দেশের বৃৃহত্তম দল তাই সচেতন মানুষ মনে করেন যে, সামনের ইলেকশনে বিএনপিই মেজরিটি পাবে। তবে দুই তৃতীয়াংশ মেজরিটি পাবে কিনা সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভবও নয়, সমীচিনও নয়। কারণ নির্বাচনের পূর্বে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে অনেক পরিবর্তন ঘটতেও পারে। সেই আলোকে কোনো দল বা জোটকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে জনমানস প্রভাবিত হতেও পারে। তবুও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএনপি মেজরিটি পাচ্ছে, এটি মানুষ ধরে নিচ্ছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়া আততায়ীর গুলিতে শহীদ হন। তখন বিএনপির হাল ধরেন তার বিধবা পত্নী বেগম খালেদা জিয়া। লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, বেগম খালেদা জিয়া তখন পর্যন্ত ছিলেন নেহায়েতই একজন গৃহবধূ। সেই গৃহবধূ সদ্য রাজনীতিতে পা ফেলেও কীভাবে দলটিকে সংহত রাখলেন এবং দলটির আরও সম্প্রসারণ ঘটালেন, শুধু তাই নয়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সম্ভবত বিএনপি নিজেও ভাবতে পারেনি, যে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। আওয়ামী লীগের মতো বিশাল এবং প্রাচীন একটি দল বিএনপির মতো তুলনামূলকভাবে কম অভিজ্ঞ একটি দলের নিকট পরাজিত হবে, এটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন? কিন্তু সেই অসম্ভবই সম্ভব হয়েছিল সেদিন।
এর কারণ, শহীদ জিয়া আবির্ভূত হয়েছিলেন সময়ের সন্তান হিসাবে। এমন পটভূমিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর তদানীন্তন জেনারেল জিয়া জনগণের নাড়ির স্পন্দন শুনতে পান। সেই স্পন্দনের সাথে মিল রেখে সংবিধানের শুরুতে উৎকীর্ণ হয় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি সংবিধানে সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে স্থাপন করেন সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে স্থাপন করেন আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা। ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে মুসলিম উম্মাহর সাথে সৌভ্রাতৃত্বের নীতিকে অগ্রাধিকার দেন।চীন,রাশিয়া, আমেরিকা ও ভারত-কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে জিয়া তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেন। জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে বাঙ্গালীত্বের সাথে তিনি যুক্ত করেন ইসলামী মূল্যবোধ। সোজা কথা, শহীদ জিয়ার রাষ্ট্রীয় নীতিতে ছিল আদর্শবাদিতা এবং বাস্তববাদীতা। এগুলিই ছিল জিয়ার অভূতপূর্ব সাফল্যের চাবি কাঠি। জিয়ার আদর্শ নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন গণতন্ত্রের মানস কন্যা বেগম খালেদা জিয়া। তারেক রহমানকে ঘিরে সাম্প্রতিক আলোচনা ও তার কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক দক্ষতা, কৌশল এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ