বছরখানেক আগেও কি আমরা ভেবেছিল বাংলাদেশের রাজনীতির পুরনো মঞ্চে একদল তরুণ ঝড় তুলবে?জুলাই অভ্যুত্থানের পরে, ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের স্লোগান উঠছিল— “নতুন বাংলাদেশ চাই”, “দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র চাই।” সেই আন্দোলন থেকেই জন্ম নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। এটি রাতারাতি ফুল ফোটার মতো নয়, বরং অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার ফসল।
এনসিপি শুরু থেকেই কিছু সাহসী ও ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। প্রথমেই তাদের লক্ষ্য— দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র গঠন, অর্থাৎ একেবারে রাষ্ট্রের কাঠামো ও সংবিধান সংস্কার। কিন্তু এটা আমাদের অনেকেই অবাক করেছে, তবে এনসিপির দলীয় ঘোষণায় যখন গণপরিষদ গঠনের কথা শোনা গেল, তখন বিষয়টি নতুন মাত্রা পেল।
আরও ভালো লেগেছে, তারা যখন নিজেদের যুব উইং গঠনের কথা জানাল। দেশের রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যাদের নিয়ে আগামী বাংলাদেশ গড়বে, তাদের কথা না শুনে, তাদের নেতৃত্বে না এনে কীভাবে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র হবে? এনসিপি বলছে, তারা তরুণদের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার আনতে চায়।
এছাড়া,জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন সে বাড়িতে গেল খোলা নসিমনে করে, ব্যয় সংকোচন করে।
সন্দ্বীপ চ্যানেলে ফেরি চলাচল শুরু হওয়ার খবরটি সত্যিই অনেকের চোখে এনসিপিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এন সি পির নেতা হান্নানের নেতৃত্বে দ্বীপবাসী যখন ৫৩ বছর পরে ফেরির সুবাদে মূল ভূখণ্ডের সাথে সরাসরি যুক্ত হলো, তখন মানুষ এনসিপির কার্যকর উদ্যোগের প্রশংসা করেছে।এতে ব্যবসায়ী, কৃষক, সাধারণ যাত্রী সবাই উপকৃত হচ্ছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী বলেছেন (২৫ শে মার্চ, ২০২৫ যুগান্তর), "আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সম্পন্ন নতুনদের স্টাইলে। সেখানে কোনো চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, স্বৈরাচার, টাকাবাজ, মাফিয়ার জায়গা হবে না। "
তখন তা নিঃসন্দেহে এক ধরনের আশার আলো দেখায়। যে দেশে নির্বাচনের কথা শুনলেই জনগণের মনে এক ধরনের সংশয় জন্মায়, সেখানে এনসিপির এমন বক্তব্য অবশ্যই নতুন করে আশাবাদী করে তোলে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়, ছাত্র আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা বলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে কিছুটা বেশি আশা করেছিল।
কিন্তু সম্প্রতি প্রথম আলো, যুগান্তরসহ একাধিক গণমাধ্যমে এসেছে, স্বাধীনতা যাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল ভাঙচুরের ঘটনায় এনসিপির রহস্যজনক নীরবতা। যে দলের মূল কথা সংস্কার ও ইতিহাস সম্মান, তারা এ ঘটনায় মুখ বন্ধ রাখলো কেন? এমন নীরবতা মানুষকে হতাশ করে। ইতিহাস ভেঙে নয়, বরং ইতিহাসের সত্যিকার শিক্ষা নিয়েই সংস্কার সম্ভব।সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৭১— ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের সামষ্টিক চেতনার অংশ। সেই ইতিহাস যেন কখনও আড়াল না হয়।
আবার এনসিপির নেতা সারজিস আলমের আলুর মাঠে ছবি তোলা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। শুধু মাঠে ছবি তুলে কৃষকের পাশে থাকা যায় না। যখন কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না, যখন শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের জন্য মানবেতর জীবনযাপন করে, তখন মাঠে ছবি নয়, তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য লড়াই দরকার। সিন্ডিকেট ভাঙা, শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া মাঠের ছবির রাজনীতি টিকবে না।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে অর্থের স্বচ্ছতা নিয়ে। এনসিপি তো স্বচ্ছতার কথা বলে, কিন্তু তাদের ইফতার পার্টি, লঞ্চিং প্রোগ্রাম, বড় বড় অনুষ্ঠানের টাকা এল কোথা থেকে? দলের জ্যেষ্ঠ নেত্রী ডা. তাসনিম জারা যখন নিজেই প্রকাশ্যে প্রশ্ন করেন— সারজিস আলমের গাড়ি বহরের টাকা এলো কোথা থেকে? তখন সাধারণ মানুষ ভাবে, এনসিপি কি আদতেই অন্য দলের মতোই হবে? আমি এখানে একটা পজেটিভ বিষয় দেখতে পাচ্ছি, তাসনিম জারার এই প্রশ্নের রাজনৈতিক দলের নতুনত্বের ইংগিত দিয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল কখনও জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করে না। উল্টো জনগণকেই রাজনৈতিক নেতার কাছে যেতে হয়। গাই ডিবোরের 'স্পেক্টাকল' তত্ত্ব অনুযায়ী,আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে জীবন বাস্তবে না থেকে "ছবির", "দেখানোর", "প্রদর্শনের" মধ্যে আটকে গেছে।এজন্য আমাদের দেশের জনগন ও রাজনৈতিক নেতার কাছে প্রত্যাশা করে যে নেতার অনেক টাকা থাকবে। আমাদের জনগনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও দরকার।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, (ঢাকা পোস্ট, ০৭ মার্চ ২০২৫) “যারা অর্থ সহায়তা করছেন, তাদের নাম প্রকাশ করলে ক্ষতির শিকার হতে পারেন।” কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— যদি সত্যিকারের সৎ সহায়তাকারী হয়, তাহলে নাম প্রকাশ করলে ক্ষতি হয় কেন? বরং এনসিপির উচিত নিজেদের থেকে স্বচ্ছতার উদাহরণ দেওয়া।
সাধারণত আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে টাকা দেয় দুটো কারণে:ব্যবসার অনিয়মজনিত সমস্যা যাতে না হয় আর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসলে বেনিফিটের আশায় যেমন :লোন পাওয়া,টাকা পাচার, ব্যবসা বাড়ানো।
এনসিপি যদি সত্যিই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে চায়, তাহলে শুধু বক্তব্য নয়, কাজের মাধ্যমেই তা প্রমাণ করতে হবে।প্রথমত, তাদের নিজেদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। এটাই হবে তাদের স্বচ্ছতার প্রথম ধাপ। যাদের মাধ্যমে এনসিপি তৈরি, সেই ছাত্র-তরুণদের মাঝেও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শুধু আলুর মাঠে ছবি তুলে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো যাবে না, বরং কৃষক ও শ্রমিকদের প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে হবে। সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের মজুরি-বোনাস পাওয়া নিশ্চিত করাই হবে এনসিপির প্রকৃত পরীক্ষা।তৃতীয়ত, ভিতরের মতপার্থক্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই মতপার্থক্য দল ভেঙে দিতে পারে বা স্বপ্নকে দুর্বল করে তুলতে পারে। দলীয় অভ্যন্তরীণ আলোচনা, গণতান্ত্রিক চর্চা জারি রাখতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এনসিপির উচিত জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করা। সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে পোস্ট নয়, প্রান্তিক সহ সব পর্যায়ের মানুষের দরজায় গিয়ে তাদের কথা শোনা, সমাধানে এগিয়ে আসা।
বাংলাদেশের ইতিহাস কখনো একক কোনো নেতা বা দলের ইতিহাস নয়। আমাদের সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রাম গণমানুষের সম্পদ। এনসিপি যদি সত্যিকার অর্থেই এই ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হতে চায়, তাহলে তাদের কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে— সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কার তারা চায়। আর তাহলেই হয়তো একদিন বাংলাদেশ পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে সত্যিকার গণতন্ত্রের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি বিভাগ।
আমার বার্তা/সাদিক আহমেদ প্রান্ত/এমই