মো. মিনহাজ সুজন। ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাব–ইন্সপেক্টর (এসআই)। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার মাত্র দশ দিন আগে ‘নাস্তা না খেয়ে হইচই’ করার অভিযোগে তাকে অব্যাহতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সুজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার গন্ধর্বপুর গ্রামে। সোলায়মান ভূঁইয়া ও সুরিয়া বেগম দম্পতির মেজো সন্তান সুজন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন।
সুজনের বাবা ছিলেন একজন তাঁতী। তার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার বাবার ব্রেন স্ট্রোক করেন এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এতে পরিবারে নেমে আসে এক কঠিন বিপর্যয়। এ প্রসঙ্গে সুজন বলেন, তখন বাবার চিকিৎসার পেছনে আমাদের ভিটেমাটি সব বিক্রি করতে হয়। একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় নিরুপায় হয়ে আমার মা আমাদের নিয়ে কৃষক নানার বাড়িতে আসেন। সেখানে আমার মা জামদানী শাড়ি বুননের কাজ শিখে তীব্র সংগ্রাম করে আমাদের বেড়ে তোলেন। বড় ভাই নিজের পড়াশোনা বিসর্জন দিয়ে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই সংসারের হাল ধরেছেন। বর্তমানে তিনি এলাকার একটি টেক্সটাইলে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। ছোট ভাই মাদ্রাসায় পড়ে।
তিনি বলেন, মায়ের টানাপোড়েনের সংসারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা ছিল আমার জন্য যেন বিলাসিতা। মাধ্যমিক থেকেই টিউশন করে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। স্নাতকোত্তরে ডিপার্টমেন্ট টপার হয়ে উত্তীর্ণ হই। দেশপ্রেমের প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে পুলিশে চাকরির প্রস্তুতি নেই। তিনবারের ব্যর্থতার পর আল্লাহর অশেষ কৃপায় ৪০ তম সাব-ইন্সপেক্টরে মাঠ পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, কম্পিউটার পরীক্ষা, ও সর্বশেষ ভাইভা পরীক্ষাসহ সকল ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য সারদা পুলিশ একাডেমিতে যাই। সেখানে ভোর সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
প্রশিক্ষণ শেষ দিকে এসে অব্যাহতি পান সুজন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘ এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষের মাত্র দশ দিন আগে নাস্তা না খেয়ে হইচই করার মতো ভিত্তিহীন অভিযোগে আমাকে চলমান প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অথচ সেদিন আমি মূল প্যারেড মাঠ থেকে দূরে অ্যাকাডেমির জিমনেসিয়ামের কাছে অবস্থিত কারাতে ও জোডো অনুশীলন প্যারেডে ছিলাম। সেখানে ওস্তাদজি নাস্তা নিয়ে আসলে আমি সেই নাস্তা খাই যা অ্যাকাডেমির সিসি টিভি ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ মিলবে।
তিনি আরও বলেন, নাস্তা খাওয়ার পরও আমাকে নাস্তা না খাওয়ার মতো ভিত্তিহীন অভিযোগে প্রথমে শোকজ করা হয়। পরবর্তীতে তিন দিনের মধ্যে লিখিত কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলে আমি সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করি। এরপর আমাকে আকস্মিক ছুটিতে পাঠানো হয় এবং ছুটিতে থাকাকালীন অবস্থায় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের নিকট হতে চাকরি হতে অব্যাহতি পত্র প্রদান করা হয়। যা সম্পূর্ণ নিয়ম পরিপন্থি।
সুজন বলেন, একটা বছর সম্পূর্ণ বিনা বেতনে ট্রেনিং করি। আমাদের প্রত্যেকের রুমে একজন করে বাধ্যতামূলক সার্ভিস বয় থাকতো এবং যাকে মাস শেষে ২৫০০ টাকা করে দিতাম। এই একবছরের ট্রেনিংয়ে সব মিলিয়ে আনুমানিক ৭০০০০ - ৮০০০০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে আমার। এই টাকা কিস্তি তুলে ও আত্মীয়স্বজন থেকে ধার করে আমার পরিবার আমাকে পাঠিয়েছিল। বর্তমানে কিস্তির টাকা ও ধারের টাকার জন্য প্রচণ্ড চাপে আছি।
তিনি আরও বলেন, ভেবেছিলাম চাকরি পেয়ে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাব, পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেব। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে আছি। সমাজের মানুষ বাঁকা দৃষ্টিতে দেখছে। এদিকে সরকারি চাকরির বয়সও প্রায় শেষ, নতুন করে চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার মতো মনোবলও হারিয়ে ফেলেছি। এ অবস্থায় মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।