গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা লাপাত্তা রয়েছেন। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনাসহ একাধিক মামলা কাঁধে নিয়ে গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে রয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের হেভিওয়েট আওয়ামী লীগ নেতারা। সরকার পতনের প্রায় তিন মাস হতে যাচ্ছে, কিন্তু এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন অনেক নেতাকর্মী।
এরইমধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলী সদস্য ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, তার বড় ছেলে দ্বাদশ সংসদের সাবেক সদস্য মাজহারুল ইসলাম সুজন, ঠাকুরগাঁও পৌরসভার সাবেক মেয়র আঞ্জুমান আরা বেগম বন্যা, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দত্ত সমীর ও ইউপি চেয়ারম্যনা রোমান বাদশা গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি হয়েছেন। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি।
আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের এক নেতা বলেন, আমাদের দলের এখন দিশাহারা, বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কারণ তিন মাস হয়ে গেলো অথচ কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।
তিনি আরও বলেন, ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা। আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।
পালিয়ে ঢাকায় আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের এক কর্মী বলেন, ‘আমরা নিজেরাই তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কাজ-কাম করবো কী করে? আর আয় না থাকলে সংসারের কী অবস্থা হয়, তা তো বুঝতেই পারছেন?। সংসার চালাতে না পেরে তার স্ত্রী প্রায়ই ফোন করে কান্নাকাটি করে। এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিছি’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জেলা শহরের চৌরাস্তায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা রাস্তায় নামেন। পাশাপাশি সমর্থকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা ও ইটপাটকেল ছোঁড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পরপর জেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর, লুট, অগ্নিসংযোগে ধ্বংসযজ্ঞে রূপ নেয়। এখন পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনে হামলায় নিহত, দোকানপাট ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতার অভিযোগে ডজনখানেক মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে আসামি করা হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের হেভিওয়টে আওয়ামী লীগ নেতাদের। তবে মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সাবেক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান অরুনাংশু দত্ত টিটোর অনুসারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, হত্যা, নাশকতা ইত্যাদির ঘটনায় একাধিক মামলায় অরুনাংশু দত্ত টিটোকে আসামি করা হয়েছে। এ কারণে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। কোথায় আছেন, তা তারা জানেন না। কোনো যোগাযোগও নেই।
জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ আপেলর একাধিক অনুসারী বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে। আপেলের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছেন তাও জানেন না। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে অনুসারীদের কোনো সমস্যা নেই। তারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
হদিস না মেলাদের মধ্যে রয়েছনে, ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বাবলু, সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায়, সহ-সভাপতি মাহাবুব হোসেন খোকন, সহ-সভাপতি ও সাবেক পৌরসভার মেয়র এস এম এ মঈন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক রুবেল, সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দ্রৌপদী দেবী আগরওয়ালা, সাংগঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী ভুট্টো, সন্তোষ আগরওয়ালা, ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অরুনাংশু দত্ত টিটো, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারুল ইসলাম সরকার, জেলা যুবলীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ আপেল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শাহ নাজমুল হুদা অ্যাপোলো, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সুনাম, আয়েশা আক্তার তুলি, ছাত্রলীগের সভাপতি আজহারুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক হিমুন সরকার, সহ-সভাপতি জি এম সুফি নিয়াজী, রয়েল বড়ুয়াসহ অন্যদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সূত্রমতে, নিজেদের রক্ষা করতে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বেকায়দায় রয়েছেন কর্মীরাও।
থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর সহিংসতার ঘটনায় ঠাকুরগাঁওয়ের ৭টি থানার মধ্যে ৩টি থানায় প্রায় ১০টি মামলা হয়েছে। বাকি থানাগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে মামলা ১০টি হলে নামসহ প্রতিটি মামলায় অন্তত শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, সহযোগিতা, হত্যা ও হত্যার চেষ্টা, উসকানিদাতা, পরিকল্পনাকারী ইত্যাদির অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রায় সব মামলাতে সাবেক সংসদ সদস্যসহ জেলা আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের আসামি করা হয়েছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর থানায় যে সব মামলা হয়েছে এবং যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরাও হবেন।