ই-পেপার সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২

নৈতিক সাহসের অভাবেই রাষ্ট্রব্যর্থতা, নিজেকে বদলানোই জাতির মুক্তি

রহমান মৃধা:
০৫ মে ২০২৫, ১০:৩১

আমি কখন ভালো হবো?—এই প্রশ্নটি যতটা ব্যক্তিগত মনে হয়, বাস্তবে তা একটি জাতির আত্মার আর্তনাদ। আজকের বাংলাদেশে এটি কেবল একজন মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা নয়, বরং এক যৌথ চেতনার কণ্ঠস্বর, যা প্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত প্রতিটি সংসারে, শ্রেণিকক্ষে, কারখানায়, আদালতে এবং সবচেয়ে বেশি, রাজনীতির মঞ্চে। কারণ আজ আর সময় নেই শুধু অপেক্ষার; সময় এসেছে নিজেকে প্রশ্ন করার—পরিবর্তনের জন্য যদি সত্যিই প্রস্তুত হই, তাহলে আমি কোথা থেকে শুরু করবো?

আমরা এমন এক দেশে বসবাস করছি, যেখানে আটজনের মধ্যে প্রায় ছয়জন মনে করে সে নিজেই নেতা—তাও শুধু নেতা নয়, যেন একেকজন সর্বজ্ঞ মহাজ্ঞানী। সবাই চায় সমাজ বদলাক, রাষ্ট্র বদলাক, নেতৃত্ব বদলাক—কিন্তু নিজেকে বদলাতে চায় না কেউ। ফলাফল? আমরা একটা নেতৃত্বপিপাসু কিন্তু দায়িত্ববিমুখ জাতিতে পরিণত হয়েছি। নেতৃত্বের নামে চলছে শুধু উচ্চকণ্ঠ চিৎকার, অথচ নেই কোন নৈতিক দৃঢ়তা। এই নেতৃত্ব জাতিকে কোথায় নিয়ে যাবে?

রাজনীতি আজ শব্দদূষণের প্রতীক। ‘নির্বাচন চাই’, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন চাই’—এই শব্দগুলো দিনে শতবার উচ্চারিত হয়, কিন্তু তার ভেতরে কোনো আত্মা নেই। নির্বাচন কি শুধুই আরেকটি ক্ষমতার পালাবদল? নাকি গণতন্ত্রের নামে একটি অপারদর্শী চক্রব্যূহ?

প্রতিটি নির্বাচন যেন একটি নতুন বিভাজনের উৎস। আর এই বিভাজনের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ হারাচ্ছে ন্যায্যতা, হারাচ্ছে আস্থা। কর্মসংস্থানের সঙ্কট, কৃষির মৃত্যুযাত্রা, দ্রব্যমূল্যের অগ্নিমূল্য, শিক্ষা ব্যবস্থার ছিন্নভিন্নতা—সবকিছু মিলিয়ে আজকের বাংলাদেশ যেন এক শ্বাসরুদ্ধকর অচলায়তন।

এই সংকটের মুখে কিছু কিছু মানুষ উপলব্ধি করছে তাদের অতীতের ভুল। এক পলাতক রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, “মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি, সত্যকে বিক্রি করেছি। আজ নিঃস্ব হয়ে বুঝছি কী করেছি।” কিন্তু সেই উপলব্ধি যখন আসে ক্ষমতা হারিয়ে, তখন তা নিছক বিলাপ—কারণ সময়মতো না বোঝার খেসারত জাতিকে গুনতে হয়।

অর্থনীতির ভিত্তি যখন নড়বড়ে, তখন দেশের মানুষের জীবন হয়ে ওঠে এক দোদুল্যমান ঝুঁকি। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার, যা একসময় আশা জাগিয়েছিল, আজ তা রূপ নিয়েছে এক ভয়াবহ কৃষ্ণগহ্বরে। এখানে টাকা ঢুকে, কিন্তু আর ফেরে না। একসময় বলা হতো, এক দরবেশ নাকি গোটা শেয়ারবাজার ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু এখন যারা আবার বাজারে ছুরি চালাচ্ছে, তারা কারা?

এই বাজার শুধু অর্থের নয়—এটি বিশ্বাস, স্বপ্ন এবং ভবিষ্যতের প্রতীক। অথচ আমরা দেখছি অপরিকল্পিত দরপতন, কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি, এবং মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের আগ্রাসন। হাজারো বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসছে। তারা চেয়েছিল দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে, কিন্তু প্রতিবার তারা প্রতারিত হয়েছে।

সরকারের প্রতি আহ্বান—এবার সত্যিকারের সংস্কার শুরু করুন। প্রয়োজনে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনুন। আমি নিজেও সাহায্য করতে রাজি। তবে আর সময়ক্ষেপণ নয়। যদি এই বাজারকে এখনই সঠিক পথে না আনা হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির ভেতরেই দেউলিয়াত্বে পতিত হবে। শুধু স্লোগান নয়, দরকার বাস্তব পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা এবং কঠোর জবাবদিহি। পুঁজিবাজার ধ্বংস মানে শুধু টাকার ক্ষয় নয়—এটি জাতির ভবিষ্যৎ হত্যা।

এই অর্থনৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন পরস্পরকে পুষ্ট করছে। একদিকে নীতিহীন রাজনীতি, অন্যদিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি—এ দুই মিলে গড়ে তুলেছে এক দানবীয় সংকট। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই একটি সমন্বিত বিপ্লব—রাজনৈতিক সংস্কার আর অর্থনৈতিক পুনর্গঠন যেন একসঙ্গে এগিয়ে চলে।

এখন প্রশ্ন একটাই—এই সংস্কার শুরু হবে কার থেকে? আমি নিজে কি ঘুষ দেই? নিয়ম ভাঙি? অন্যায় দেখে চুপ থাকি? নাকি প্রতিবাদ করি? এই প্রশ্নগুলোই আমাদের বদলের আসল সূচনা। রাষ্ট্র বদলায় না, মানুষ বদলে গেলে তবেই রাষ্ট্র বদলায়।

আজ যারা আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই দেশের মাটিতে নেই। কেউ দিল্লির স্বপ্ন দেখে, কেউ ওয়াশিংটনের। তারা গোপনে চুক্তি করে, ওপেনলি ‘ত্যাগ’ দেখায়। কিন্তু আত্মশুদ্ধির কথা কেউ বলেন না—কারণ আত্মশুদ্ধি কঠিন, দায়বদ্ধতা কঠিন।

তাই আজ দরকার একটি নিরব বিপ্লব—যার সূচনা হবে এই আত্মজিজ্ঞাসা থেকে: আমি কখন ভালো হবো? এই বিপ্লব হবে আমাদের পরিবারে, প্রতিদিনের সিদ্ধান্তে, পেশাগত দায়িত্বে। কারণ আজ যদি আমি নিজেকে না বদলাই, কাল নতুন মুখে আবার পুরনো প্রতারণাই আমার সামনে হাজির হবে।

আমরা পরিবর্তন চাই, কিন্তু ভুলে যাই—পরিবর্তনের গভীরতম শেকড় নিজেকেই খুঁড়তে হয়। তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন—আমি কখন ভালো হবো? হয়তো তখন আপনি নিজেই হয়ে উঠবেন সেই “সুন্দর কে”, যাকে সবাই খোঁজে, কিন্তু নিজের ভেতরে দেখে না।

আজকের বাংলাদেশে, সত্যিকারের নেতা পাওয়া কঠিন। চারদিকে এক ‘নেতাগণমণ্ডলী’—যিনি নেতা নন, তিনিও নিজেকে নেতা ভাবেন। অথচ নেতৃত্ব মানে বিনয়, দায়িত্ব, নৈতিকতা, আত্মসংযম। এই চারটি গুণই আজ প্রায় অদৃশ্য।

এই অতিনেতৃত্বপ্রবণতা আমাদের সমাজে এনেছে এক সাংস্কৃতিক দূষণ। রাজনীতিকরা সারাবছর ধরে ‘নির্বাচন’ শব্দটি এতবার বলেন, যেন সেটাই তাদের পণ। কিন্তু এই ‘নির্বাচন’ আসলে কী? ক্ষমতা রক্ষার আয়োজন? না সত্যিকারের জনগণের দাবি পূরণের একটি সুযোগ?

আমরা সবাই বলি, ‘জনগণ কিছু করে না।’ কিন্তু আমি নিজে তো সেই জনগণের অংশ। আমি যদি চুপ থাকি, আমি যদি প্রতিবাদ না করি, আমি যদি অন্যায় মেনে নিই—তবে আমিও দায়ী। গণতন্ত্র মানে ‘কেউ একজন কিছু করবে’ নয়—মানে, আমি নিজেই কিছু করবো।

‘সুন্দর মানুষ’ কাকে বলে? যে তার নিজের ভেতরে আলো জ্বালাতে পারে। সেই আলো দিয়েই সে অন্যকে পথ দেখায়। হয়তো আপনি নিজেই সেই মানুষ—শুধু তাঁকে জাগিয়ে তুলুন।

রাজনীতির নামে আজ চলছে পেশিশক্তি, দখল, দুর্নীতি। আর শেষে উচ্চারিত হয়—“নির্বাচন চাই!” অথচ যেখানে নেই ভয়হীনতা, নেই চিন্তার স্বাধীনতা, নেই ভোটারের নিরাপত্তা—সেখানে নির্বাচন মানে এক প্রহসন।

যদি রাজনীতির এই দূষণ দূর না হয়, তাহলে কোনো নির্বাচনই স্বচ্ছ হবে না। কারণ নির্বাচন একটি ফল, এবং ফল পেতে হলে চাই একটি স্বাস্থ্যবান পরিবেশ। যদি চারপাশের বাতাসই বিষাক্ত হয়, তাহলে সেই ফলও বিষাক্ত হবে।

তাই শুধু শব্দ নয়, দরকার চরিত্রের শুদ্ধি। রাজনীতিবিদদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে—আমি কতটা স্বচ্ছ? আমি কি জবাবদিহিমূলক? আমি কি সত্য বলি? না সুবিধামতো চুপ থাকি?

আপনি যদি সংবাদপত্র বন্ধ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পেটোয়া বাহিনী চালান, দুর্নীতিকে আশ্রয় দেন—তাহলে আপনি যখন নির্বাচনের মুখোমুখি হবেন, তখন জনগণ কেন আপনাকে বিশ্বাস করবে?

জনগণ আজ আর অন্ধ নয়। তারা জানে, কারা শুধু শব্দে দেশ চালাতে চায়, আর কারা সত্য সংস্কার আনতে চায়। তাই যারা আজ ‘নেতা’—তাঁদের শেষবারের মতো আত্মদর্শনের দরকার। ভারতের দিকে পলায়ন নয়, বরং নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখা দরকার।

এই রাষ্ট্রকে যদি সত্যিই বাঁচাতে চাই, তবে প্রথমেই দূর করতে হবে নৈতিক দূষণ। নিজের কাছে জবাবদিহি করতে শিখুন। কারণ, সেই ‘সুন্দর কে’, যাকে আমরা খুঁজি—সে হয়তো আমি, হয়তো আপনি। শুধু নিজের ভেতরে তাকাতে শিখলেই তাঁকে খুঁজে পাবো।

(প্রকাশিত লেখাটির আইনগত মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, ডেল্টা টাইমস্ কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার ডেল্টা টাইমস্ কর্তৃপক্ষ নেবে না। )

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

আমার বার্তা/জেএইচ

অনিয়ন্ত্রিত ঋণ ও খেলাপি সংস্কৃতি : ব্যাংকিং খাতের আত্মহননের ছক

ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বলা হয় অর্থনীতির হৃদযন্ত্র। এই হৃদযন্ত্র যদি রক্ত পাম্প না করে, রাষ্ট্র নামের

রাখাইন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক করিডোর

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশীরভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে এবং পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রন

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের হুমকি : আঞ্চলিক নিরাপত্তার পথে সবচেয়ে বড় বাধা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

আইনের শাসনই রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আইনের শাসন। এই শাসন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালুর জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি

কালোমেঘের ভিতরে একটি মেয়ে হাঁটে

সৌদি আরবে আরও দক্ষ কর্মী নিয়োগের আহ্বান আসিফ নজরুলের

সংবিধান ও গণতন্ত্রের ভারসাম্য রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ: প্রধান বিচারপতি

ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, মালয়েশিয়া সফর বাতিল করলেন শেহবাজ

আদালত আমাদের সেকেন্ড হোম হয়ে গেছে: গয়েশ্বর

কিউইদের বিপক্ষে সহজ জয়ে ‘এ’ দলের সিরিজ শুরু

ভারতকে ভয় দেখাতে আরও এক শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা পাকিস্তানের

খাদ্য নিরাপত্তায় জোর দিতে গিয়ে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে: ফরিদা আখতার

কসবা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত

এক বাটিতেই সবজি আর সুক্তোর রেসিপি

নারায়ণগঞ্জে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার ২

দুই পুত্রবধুকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরছেন বেগম খালেদা জিয়া

হাসপাতালে বসে মামলার বাদীকে হুমকি দিচ্ছেন দিলীপ আগরওয়ালা

সলিট হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে কুপিয়ে হত্যা

ভারত-পাকিস্তান সংকটের সমাধানে সহায়তার প্রস্তাব রাশিয়ার

ক্লাসরুমে স্মার্ট টিভির বদলে আসছে ‘ইন্টারঅ্যাকটিভ প্যানেল’

পাপন দম্পতির বিরুদ্ধে সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

জামিনে মুক্ত আ.লীগ নেতা পুনরায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ

সারাদেশে চোরাই ব্যান্ডউইথের ব্যবহার বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার