সভ্যতা ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে নোবেল পুরস্কারের অবদান অনেক। বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তি এই ক্ষেত্রগুলোতে নোবেল পুরস্কার যে পরিমাণ অবদান রেখেছে তা আসলেই পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। আজ আমরা যে যুগে বসবাস করছি তার ভিত রচিত হয়েছে গত শতাব্দীতে। আধুনিক প্রযুক্তি, আয়েশি জীবন, কালজয়ী সাহিত্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ পেরিয়ে শান্তির সময়ে প্রবেশ ইত্যাদি অনেক কিছুরই শেকড় ছড়িয়ে আছে গত শতাব্দীতে।অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে গত শতাব্দীর বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তির সকল ক্ষেত্রে অলঙ্কার হিসেবে আলোকিত হয়ে আছে নোবেল পুরস্কার। নিঃসন্দেহে নোবেল পুরস্কার অনেক প্রশংসনীয় ব্যাপার। কিন্তু তারপরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই পুরস্কারকে ঘিরে জন্ম হয় বিতর্ক। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পুরস্কারগুলো নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই, যতটা শান্তির পুরস্কারের বেলায় আছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে সব সময়ই কিছু না কিছু প্রশ্ন ওঠে। এসব প্রশ্ন মাঝে মাঝে পুরো নোবেল কমিটিকেই বিতর্কের মুখে ফেলে দেয়। ২০২৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জাপানের নিহোন হিদানকিয়োকে, যা পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এটি মূলত হিরোশিমা ও নাগাসাকির পরমাণু হামলায় বেঁচে যাওয়া মানুষের হিবাকুশা সংগঠন, যারা ১৯৫৬ সাল থেকে পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রচার চালিয়ে আসছে। তাদের সংগ্রাম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা মানব সভ্যতার জন্য কতটা বিপর্যয়কর। নিহোন হিদানকিয়োর কাজ শুধু জাপানের মানুষের জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী শান্তি আন্দোলনের জ্বলন্ত উদাহরণ।
দেখা গেছে,২০১৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস’-আইক্যান, যা পরমাণু অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রচার চালায়। আইক্যানের নেতৃত্বে চালানো পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চলতি বছর যখন পরমাণু সংঘাতের শঙ্কা বেড়েছে তখন এবং ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দুই বছরই দুটি পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠনের নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তি জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষত আইক্যানের প্রচেষ্টার মূল শক্তি ছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি পাস এবং স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া। পরমাণু অস্ত্রবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে তৎপর নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাজকে জাতিসংঘের কাঠামোতে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কারণ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রধান লক্ষ্য বৈশ্বিক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু পরমাণু অস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক অস্ত্রগুলো অনেক দেশের অস্ত্রাগারে রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০১৭ সালে আইক্যানের পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ প্রচারাভিযান এবং ২০২৪ সালে নিহোন হিদানকিয়োর পরমাণু অস্ত্রবিরোধী প্রচেষ্টাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে এটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে- বিশ্বশান্তি রক্ষায় জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। কিন্তু এসব আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষত জাতিসংঘের ভূমিকায়।
জাতিসংঘ যদি কার্যকরভাবে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এসব উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে না। জাতিসংঘের কাঠামোতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে ভেটো ক্ষমতা বা প্রভাবশালী দেশগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছা। এই ক্ষমতার কারণে পরমাণু অস্ত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে কোনো আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। যেমন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা পরমাণু অস্ত্র নির্মূলের ক্ষেত্রে বড় বাধা। একইভাবে চীনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও জাতিসংঘের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। ফলে জাতিসংঘের মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্রের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে হলে জাতিসংঘকে একটি স্বচ্ছ এবং শক্তিশালী নীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। পরমাণু অস্ত্রের মতো মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ বিষয়গুলোতে জাতিসংঘের নেতৃত্ব আরও কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। শুধু জনগণের উদ্যোগ নয়, বরং বিশ্বনেতাদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেয় না, বরং এটিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানায়। শান্তির জন্য কেবল পারমাণবিক বোমা নির্মূলই যথেষ্ট নয়; বিরাজমান সংঘাত, শরণার্থী পরিস্থিতি ইত্যাদি বন্ধে জাতিসংঘকে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে হবে। যেমন রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে চীন বা রাশিয়ার ভূমিকা ইতিবাচক হলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর পথ সৃষ্টির সুযোগ হতো।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরায়েলের ওপর হামাসের আক্রমণ, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা এবং বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যকার রকেট হামলা ও স্থলাভিযানে পরাক্রমশালী দেশগুলোর ভূমিকার কারণে জাতিসংঘ প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশ্ববাসী এমন যুদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি চায়।আর তা বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব জাতিসংঘের।তা ছাড়া বিশ্বকে জলবায়ু সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার মাধ্যমে অনেক স্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ষাটের দশকে ইসরাইল ও মিসরের মাঝে যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে আরবদের অনেক স্থান দখল করে নেয় ইসরাইল। সেজন্য আনোয়ার সাদাত শান্তি চুক্তি করেন ইসরাইলের সঙ্গে। এর ফলে এলাকা ফিরে পায় মিসর। এই চুক্তির জন্য ১৯৭৯ সালে দুজনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ দুজনই ছিলেন বিতর্কিত। দুজনই ছিলেন সহিংস আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পরপরই ২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান বারাক ওবামা। আমেরিকার নির্বাচনের সময় সারা পৃথিবীতেই তোলপাড় হয়। তখনকার সময়ে যারা নির্বাচনের খবর রেখেছে তারা দেখেছে নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি শেষ হতে না হতেই ওবামা পেয়ে গেছেন নোবেল। নোবেল কমিটি বলছে দুর্নীতি দমনে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, অস্ত্র ও যুদ্ধ নিরসনকল্পে গৃহীত পদক্ষেপের জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অফিসিয়ালি কাজকর্মের বয়স মাত্র কয়েকমাস। এত স্বল্প সময়ে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এত জটিল ব্যাপারসমূহের সমাধান সম্ভব নয়।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্ক হিসেবে থাকবে ওবামার এই পুরস্কার। ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি আত্মজীবনীতে নোবেল কমিটির প্রাক্তন সদস্য গেয়ার লান্ডেস্টাড এই ব্যাপারে কিছু কথা বলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল যেন আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাব শক্তিশালী হয় এবং তার ক্ষমতায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আরও আছেন রিগোবার্তা মেঞ্চু, যিনি গুয়াতেমালা থেকে পালিয়ে মেক্সিকো চলে গিয়েছিলেন এবং অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে একটি বই লিখেছিলেন। তার বইতে উল্লেখ করা গুয়াতেমালার বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন এবং মানুষের সংগ্রামের বর্ণনার জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে গবেষণায় বেরিয়ে আসে তার বইয়ের বর্ণনা মিথ্যা, ভুল ও বানোয়াট তথ্যে ভরা। এই মর্মে বিতর্ক বিদ্যমান যে, তিনি এর জন্য শান্তিতে নোবেল পাবার যোগ্যতা রাখেন না। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও আছে শান্তিতে বিতর্কিত নোবেল জয়ীদের তালিকায়। শান্তির পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও অযোগ্যদের পুরস্কৃত করা হয় মাঝে মাঝে। আবার মাঝে মাঝে অতি যোগ্যদেরকেও পুরস্কার দেয়া হয় না। যেমন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের অন্যতম ব্যর্থতা হলো মহাত্মা গান্ধীকে নোবেল না দেয়া। সাহিত্যে নোবেল পাননি লিও টলস্টয়, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, রবার্ট ফ্রস্টের মতো সাহিত্যিকরা। বিজ্ঞানে পাননি সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের মতো মেধাবীরা। সত্যিকারের যোগ্যরা পুরস্কার পাক এবং নোবেল কমিটিও থাকুক বিতর্কের উর্ধে-এমনটাই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ