জলবায়ু পরিবর্তনের চাপে নুইয়ে পড়া বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদে সুপেয় পানির সংকট যেন এক নিত্যদিনের যুদ্ধ। লবণাক্ততা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিদিনই লড়ছেন আশাশুনি, মংলা, পাথরঘাটার মানুষ। তাদের জীবন ও জীবিকায় এক স্বস্তির ছোঁয়া আনতে এবার ডেনমার্কের সহযোগিতায় ব্র্যাক শুরু করলো তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প ‘রেইন ফর লাইফ’। এই প্রকল্প শুধু নিরাপদ পানি নয়, উপকূলজুড়ে মানুষের জন্য গড়ে তুলবে এক ধরনের জলবায়ু সহনশীলতা, যার কেন্দ্রে থাকছে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে নারীর নেতৃত্ব।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত কর্মশালায় ‘রেইন ফর লাইফ’ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ঘোষণা করা হয়। প্রকল্পটি সাতক্ষীরার আশাশুনি, বাগেরহাটের মংলা ও বরগুনার পাথরঘাটায় ৯০ হাজারেরও বেশি মানুষের জন্য নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা এবং খাদ্য নিরাপত্তায় সহনশীলতা তৈরি করবে।
জানা গেছে, প্রকল্পের মূল উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে,পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাশয়ের পানি পরিশোধন ও পুনঃব্যবহার, জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্চা এবং ‘অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক’ মডেলের বিস্তার, নারীর নেতৃত্বে ক্ষুদ্র কৃষকের প্রযুক্তি ও অর্থায়ন সহায়তা, ‘আমার বন’ মডেলের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ ও স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ এবং ক্লাইমেট অ্যাকশন গ্রুপ ও তরুণদের সম্পৃক্ততা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিকস মোলার বলেন, এই প্রকল্প শুধু মানুষ নয়, পরিবেশ, কৃষি ও গবাদিপশুর জন্যও নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা দেবে। এটি বাংলাদেশের জলবায়ু নেতৃত্বের প্রতি ডেনমার্কের আস্থা ও অংশীদারিত্বের প্রতীক।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ বলেন, জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরাই অভিযোজনে সবচেয়ে বেশি সক্ষম। রেইন ফর লাইফ প্রকল্পে আমরা সেই সক্ষমতাকে শক্তিতে রূপ দিতে চাই। নিরাপদ পানি আর খাদ্য নিরাপত্তা—এই দুই সংকট একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আমাদের সমাধানও হতে হবে সমন্বিত, টেকসই ও স্থানীয়ভাবে চালিত।
পরিকল্পনা সচিব ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, জলবায়ু সংকটের কোনো ম্যাজিক সমাধান নেই। অভিযোজনই আমাদের মূল পথ। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে এমন প্রকল্পগুলোকে বিস্তৃত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, নিরাপদ পানি কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মৌলিক অধিকার। উপকূলের মানুষ দীর্ঘদিন তা থেকে বঞ্চিত। ব্র্যাক মাঠ পর্যায়ে যে পরিশ্রম করছে, তারা আমাদের এই অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. নাজমুন নাহার করিম বলেন, নারীদের শুধু উপকারভোগী নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে যুক্ত করলেই প্রকৃত অভিযোজন সম্ভব। রেইন ফর লাইফ সেই রূপরেখাই তুলে ধরছে।
মোংলার কৃষক জাহিদুল ইসলাম বুলবুল বলেন, লবণ পানি জমিতে ঢুকে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। পরিষ্কার পানি না থাকায় গবাদিপশুও অসুস্থ হয়। এখন আমরা আশায় বুক বাঁধছি।
স্থানীয় নারী প্রতিনিধি শিপ্রা হালদার বলেন, আমাদের এলাকায় নারীই পানি সংগ্রহ করে। অথচ কোনো সিদ্ধান্তে আমাদের ডাকা হয় না। এই প্রকল্পে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, এটা আমাদের সাহস বাড়ায়।
তরুণ প্রতিনিধি ঐতি রায় বলেন, আমরা শুধু ক্ষতির গল্প শুনি, কিন্তু রেইন ফর লাইফ বলছে—আমরাও সমাধানের অংশ হতে পারি।
প্রসঙ্গত, ‘রেইন ফর লাইফ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২২-২০২৪ সময়কালে ৭২ হাজার মানুষকে নিরাপদ পানির আওতায় আনা হয়েছিল। এখন সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় পরিসরে এগিয়ে যেতে চায় ব্র্যাক। ব্র্যাকের জলবায়ু কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, এটি শুধু পানি নয়, এটি এক ধরনের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে মানুষ, প্রকৃতি ও সম্ভাবনা একত্রিত হয়।
আমার বার্তা/এমই