চলতি মে মাসের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চারদিনের হামলা, পাল্টা হামলা ও সামরিক উত্তেজনা যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়েছে। দুই দেশই নিজেদের বিজয়ী দাবি করেছে।
তবে সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত থেকে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মিরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এরপর ৭ মে ভারত “অপারেশন সিন্দুর” নামে পাকিস্তানে ও পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মিরে বিমান হামলা চালায়।
ভারত দাবি করে, হামলায় লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদ-এর ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ১০০ সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের আক্রমণ চলতে থাকে।
ভারত এই সংঘাতে ফরাসি ও রুশ নির্মিত ফাইটার জেট ব্যবহার করে; অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সহায়তায় তৈরি করা জেএফ-১৭ থান্ডার ও জে-১০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। যদিও দুই দেশই দাবি করে, তাদের বিমান সীমান্ত অতিক্রম করেনি—তারা দূর থেকে মিসাইল ছুঁড়েছে।
সংঘাত শুরুর পর পাকিস্তান জানায়, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জে-১০ যুদ্ধবিমান ভারতীয় বিমান বাহিনীর রাফাল ফাইটার জেটসহ ছয়টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত সরকার এই দাবির কোনও সরাসরি জবাব দেয়নি। নয়াদিল্লি কেবল বলেছে, ক্ষয়ক্ষতি যুদ্ধের অংশ।
ভারতের এয়ার মার্শাল এ.কে. ভরতি বলেছেন, “যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি হতেই পারে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে এবং সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছেন”। এছাড়া কিছু সংবাদমাধ্যম ভারতের পাঞ্জাব ও কাশ্মির অঞ্চলে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর দিলেও ভারত সরকার এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ।
জে-১০সি : যুদ্ধক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়ানো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, পাকিস্তান সম্ভবত জে-১০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভারতের যুদ্ধবিমানের ওপর আকাশ থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এতে চীনের অস্ত্রশিল্প একটি বাস্তব যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেদের কার্যকারিতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছে, যা এর আগে হয়নি।
মূলত পাকিস্তান চীনের অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে যে সফলতা পেয়েছে, তা চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য এক বড় সুযোগ বলে অনেকে মনে করছেন।
পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান দেখে পালাল ভারতের ৪টি রাফাল যুদ্ধবিমান
চীনা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল ঝোউ বো বিবিসিকে বলেন, “এই সংঘর্ষ চীনের অস্ত্রশিল্পের জন্য একপ্রকার বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে। চীন এতদিন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজের প্রযুক্তির কার্যকারিতা প্রমাণের সুযোগ পায়নি। এবার দেখা গেল চীনের কিছু সিস্টেম বিশ্বের যেকোনও অস্ত্রের সঙ্গে টক্কর দিতে সক্ষম।”
পাকিস্তান ও ভারতের এই সংঘাতের পর চীনের অভিক চেংদু এয়ারক্রাফট কোম্পানির শেয়ারের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এখনই চীনের প্রযুক্তিকে সেরা বলে বিবেচনা করা যাবে না।
লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, চীনের যুদ্ধবিমান ভারতের রাফালকে সত্যিই পরাস্ত করেছে কিনা, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
চীন এ নিয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও মন্তব্য করেনি, তবে চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি উঠেছে যে জে-১০ যুদ্ধবিমান পশ্চিমা প্রযুক্তি ব্যবহৃত রাফাল বিমানকে নামিয়ে দিয়েছে—এ নিয়ে সেখানে উল্লাসও চলছে। অন্যদিকে ভারত নিজেও বিস্তারিত কিছুই জানায়নি, ফলে আন্তর্জাতিক প্রচারেও ভারত পিছিয়ে গেছে।
ভারোনার ইন্টারন্যাশনাল টিম ফর দ্য স্টাডি অব সিকিউরিটির চীন বিশেষজ্ঞ কার্লোত্তা রিনাউডো বলেন, “প্রকৃত সত্যের চেয়ে এখন মানুষের ‘ধারণা’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই সংঘাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীনই।”
চীনের জন্য পাকিস্তান কেবল কৌশলগত নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’ প্রকল্পে চীন ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। মূলত ৫ হাজার কোটি ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরই এই সম্পর্কের ভিত্তি।
পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল বলেন, “এই সংঘাতে চীনের সমর্থন ভারতের পরিকল্পনাকে চমকে দিয়েছে। ভারত এতো ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা আশা করেনি। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তান-চীন সহযোগিতার গভীরতা তারা (ভারত) আঁচ করতে পারেনি।”
চীন সাধারণত মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। আগের সময়ে চীনা অস্ত্রের মান ও কারিগরি ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা ছিল—মিয়ানমার ও নাইজেরিয়ায় জেএফ-১৭ ও এফ-৭ বিমানের সমস্যা তার উদাহরণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংঘাতে চীনের অস্ত্র ব্যবহারের পারফরম্যান্স পশ্চিমা দেশগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। এতে বিশ্ব অস্ত্র বাজারে বড় প্রভাব পড়বে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ, আর তালিকায় চীন রয়েছে চতুর্থ স্থানে।
অবশ্য পাকিস্তানের হাতে ভারতের যুদ্ধবিমান হারানোর ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালে ভারতের এক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান পাকিস্তান সীমান্তে গুলি করে নামানো হয় এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে ভারতীয় পাইলট বন্দি হন।
এদিকে চলমান সংঘাতের শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলোর চাপেই মূলত পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংঘাতের এই পর্বটি ভারতের জন্য এক সতর্ক সংকেত। কারণ চীন ইতোমধ্যেই জে-২০ স্টেলথ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে, যা রাডারে ধরা পড়ে না।
যদিও এই যুদ্ধবিমানগুলো এখনও পাকিস্তানকে দেয়নি বেইজিং।
অন্যদিকে ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে এবং এ নিয়ে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে পরাজয়ের শিকার হয়েছিল ভারত। আর সর্বশেষ ২০২০ সালে সীমান্তে উখয় দেশের সৈন্যদের মধ্যে লাদাখে সংঘর্ষ হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এখন জানে তাকে দ্রুত দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অস্ত্র ক্রয়েও গতি আনতে হবে। আর এই মুহূর্তে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প আন্তর্জাতিক আলোচনায় এগিয়ে আছে, বিশেষ করে তাদের তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমানের সাফল্যের কারণে।
আমার বার্তা/জেএইচ