ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিরূপণে তথ্যভাণ্ডার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে ৬১৮ জনের প্রাণহানির তথ্য নিশ্চিত করেছে তারা। আহত প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ তালিকা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে চূড়ান্ত তথ্য পেতে আরও সময় লাগবে, বলছে সংস্থাটি।
জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আন্দোলনে যোগ দেন সাধারণ মানুষও। ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের।
আন্দোলনে প্রাণহানি ও আহতদের সংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। এর সঠিক সংখ্যা নিয়ে তথ্যভাণ্ডার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কাছে চাওয়া হয়েছে তথ্য।
৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যে দেখা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন ৬১৮ জন। এর মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান ৪৪০ জন। চিকিৎসাধীন মৃত্যু হয়েছে ১৭৮ জনের। আর আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৮৬৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘আন্দোলনে আহত-নিহতদের তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া আগে থেকেই চলছিল। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে এটি আরও জোরালো হয়েছে। এখন কোনো তাড়াহুড়ো না করে সঠিক তথ্য নিরুপণের চেষ্টা করছি আমরা।’
তবে অনেকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন। নানা জটিলতায় অনেক প্রতিষ্ঠান হতাহতের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, আন্দোলনে গুরুতর আহত হন তিন হাজারের বেশি। অঙ্গহানি হয়েছে ১১৬ জনের।
জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ভারতীয় একটি গণমাধ্যমকে সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ছাত্র আন্দোলনে এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আন্দোলন ঘিরে হতাহতের তথ্য সংগ্রহে ছাত্রদের উদ্যোগে তৈরি হয় ‘শহীদ ইনফো’ নামে একটি ওয়েবসাইট।
>> কী বলছেন বিশ্লেষকরা
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন স্তব্ধ করতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। গুলিতে অনেক হতাহত হয়েছে। নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তার করা হয়। হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা বের করা দরকার। জাতিসংঘ স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত করলে সঠিক সংখ্যা বেরিয়ে আসবে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে যে হিসাব পাচ্ছি, এর সবক’টিতে নিহতের সংখ্যা ছয়শর বেশি।
সারা হোসেন আরও বলেন, আন্দোলনের সময় মারা যাওয়া অনেকে কাউন্সিলর বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘হৃদরোগে মারা গেছেন’ এমন প্রত্যয়নপত্র নিতে বাধ্য হয়েছেন। কে কীভাবে হতাহত হয়েছেন এর সঠিক তথ্য ন্যায়বিচারের জন্য ভুক্তভোগীর পরিবারের জানা জরুরি। এ ছাড়া এখনও আহত শত শত মানুষ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের পাশে সরকারি-বেসরকারিভাবে সবাইকে দাঁড়ানো উচিত।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, এত বীভৎস ও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, অনেকের লাশ রাস্তায় পড়ে ছিল। চিকিৎসা দিতে হাসপাতাল হিমশিম খেয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়া অনেকে লাশ নিয়ে গেছেন। ফলে সহসা নিহতের প্রকৃত সংখ্যা চূড়ান্তভাবে জানা সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমাধ্যমে একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারে। এতে হতাহতের সংখ্যা জানা যেতে পারে। এনজিও এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজে লাগাতে পারে তারা। কারণ তৃণমূল পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্ক আছে।
>> সমন্বয়ক বাকেরের ভাষ্য
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার মনে করেন, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করতে না পারাটা ব্যর্থতা। সরকার একটি সেল গঠনের মাধ্যমে কাজটি করতে পারে। পাশাপাশি প্রতিটি জেলায় সমাজকল্যাণ দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে জেলাভিত্তিক নিহতের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি দলও নিহতদের তালিকা তৈরির কাজটি করছে বলে জানান তিনি।
আমার বার্তা/এম রানা/জেএইচ