জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬টি জলাশয় রয়েছে। এবছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্যাম্পাসের গাছগাছালি ও জলাশয়গুলোতে আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখি। ক্যাম্পাসে যেসব পরিযায়ী পাখি দেখা যায়, এদের অধিকাংশ হাঁস জাতীয় বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি গবেষক ও পাখি প্রেমিরা। গতবছরের তুলনায় এবছর তুলনামূলক অধিক সংখ্যক পরিযায়ী পাখি ক্যাম্পাসে আসা শুরু করেছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে গাছে বসবাসকারী পাখি বৈচিত্র্য না কমলেও জলাশয়ে বসবাসকারী অতিথি পাখির প্রজাতিগত বৈচিত্র্য কমেছে।
মাস্টারপ্ল্যানবিহীন উন্নয়নের ফলে বৃক্ষনিধণ, জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ, জলাশয়গুলোর যথাযথ পরিচর্যার অভাব, অতিরিক্ত যানবাহনের শব্দ, বহুতল ভবন নিমার্ণের শব্দ, দর্শনার্থীদের ভীড় ইত্যাদি কারনকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, এ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে প্রায় ১২ প্রজাতির হাঁস পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ১০ প্রজাতি পরিযায়ী। রাজ সরালি, মরচেরঙ-ভূতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও পাখিপ্রেমি মো. সাঈদ হোসেন বলেন, মূলত যে হাঁসটা আমরা শীতে সব জলাশয়ে দেখি, সেটি আমাদের দেশীয় হাঁস পাতি সরালি। বর্তমানে পাতি সরালিও আগের তুলনায় অনেক কম আসতে দেখা যায়, সংখ্যা বিবেচনায় অর্ধেকেরও কম হবে। ক্যাম্পাসে বেশ কিছু নির্মাণকাজ, লেকগুলো কচুরিপানায় ভরে যাওয়া, লেকগুলোর নিয়মিত পরিচর্যা না করা প্রধান কারন।
তিনি আরো যুক্ত করেন, ওয়াইল্ডলাইফ রেস্কিউ সেন্টারের সামনে দুইপাশের জলাশয় সরালিসহ পরিযায়ী হাঁসগুলোর প্রিয় আবাসস্থল, যেগুলো গত কয়েকবছর ধরে খুব অবহেলিত হয়ে আছে। এই দুটি জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে নিয়মিত পরিচর্যা করলে আবারও দেশীয় এবং পরিযায়ী হাঁসের বিচরণক্ষেত্র হতে পারবে জাহাঙ্গীরনগর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখিরা মঙ্গোলিয়া, নেপাল ও হিমালয় অঞ্চলে শীত ও ভারি তুষারপাতে টিকতে না পেরে উষ্ণতার খোঁজে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এসব পরিযায়ী পাখিরা নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যায়। কিছু প্রজাতি হাজার হাজার মাইল পারি দিয়ে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে খাদ্য ও বংশবিস্তারের জন্য আসে। এসব পাখিগুলো ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি জলাশয়ে আশ্রয় নিলেও পরিবহন চত্বর সংলগ্ন জলাশয়, নতুন রেজিস্ট্রার ভবনের পেছনের জলাশয়, ওয়াইল্ডলাইফ রেস্কিউ সেন্টার (ডব্লিউআরসি) এর সামনের জলাশয়ে বেশি দেখা যেত। এই জলাশয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০২০ সালে বড় ভূতিহাঁস নামের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি এই জলাশয়ে পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া নীলমাথা হাঁস, মরচেরঙ ভূতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পিয়াং হাঁসসহ অনেক পরিযায়ী পাখি এই জলাশয়ে একসময় দেখা মিলতো। বর্তমানে ক্যাম্পাসে পরিযায়ী পাখি আসলেও আগের মতো বৈচিত্র্যময়তা দেখা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. মনিরুল হাসান খান বলেন, দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি আগমন কমতির দিকে। এটি সংখ্যা গত দিকের চেয়ে প্রজাতিগত দিক থেকে বেশি কমতির দিকে। গত দুয়েক বছরের মধ্যে কিছুটা কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারনের মধ্যে ক্লাইমেট(জলবায়ু), তাপমাত্রা ইত্যাদি কারন রয়েছে। আগে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের জলাশয়ের দক্ষিন দিকে বেশি আসতো। কিন্তু এখন বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও কচুরিপানায় ভরে গেছে। জলাশয়ে বসবাসকারী পাখি বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার মূল কারন আবাসস্থলগুলো যে অবস্থায় ছিলো এখন সে অবস্থায় নেই। তবে, গাছে বসবাসকারী পরিযায়ী পাখির বৈচিত্র্য তেমন কমেনি।
একই বিভাগের আরেক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ক্যাম্পাসে বর্তমানে ৬ থেকে ৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। ধীরে ধীরে পরিযায়ী পাখি আগমন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস করে অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কারণে অতিথি পাখি কমছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
আমার বার্তা/সৌরভ শুভ/এমই