এসএসএফ ডিজিকে কেন ‘টার্গেট’ করা হলো?

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৫৯ | অনলাইন সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিবেদক‍:

রাজধানীর বসুন্ধরার কে ব্লকের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আলী হোসেন শিশির। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিশেষ করে ইউটিউবে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মাহবুবুস সামাদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জোর অপতৎপরতা চলছে। বলা হচ্ছে, ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ডিজি। এমনকি তাকে গ্রেপ্তারেও নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন তিনি। মূলত প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে তাঁর দীর্ঘ চাকরি জীবনের অর্জিত সুনাম বিনষ্ট করতে এক তরফা বানোয়াট ভিডিও ও অপতথ্য বাস্তবায়নে একটি চক্র ওঠেপড়ে লেগেছে। কার্যত ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে তাঁর বাসায় আশ্রয় দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

মূলত শিশির ছিলেন ওই ভবনের অন্যসব ভাড়াটিয়াদের মতোই একজন। রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করে সিআইপি পরিচয়ে তিনি বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। পুলিশ এসএসএফ ডিজিকে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত বিষয়টি জানানোর পর তিনি পুলিশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। তিনি শিশিরকে গ্রেপ্তার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও পুলিশকে অনুরোধও জানিয়েছেন। কিন্তু সত্যকে পাশ কাটিয়ে ডিজিকে ‘আওয়ামী দোসর’ ‘ট্যাগ’ দিয়ে একটি চক্র নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে। অথচ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল মাহবুবুস সামাদ চৌধুরী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের পথচলা শুরুর পর অন্তর্বর্তী সরকার তাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এসএসএফ ডিজি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে।

রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ভিভিআইপি বিদেশি সম্মানিত অতিথিদের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করা আধুনিক ও সুসজ্জিত বাহিনী এসএসএফ’র ডিজিকে নিয়ে এমন বেশুমার অপপ্রচারে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে প্রধান উপদেষ্টার (সিএ) প্রেস উইং। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার (সিএ) প্রেস উইং থেকে পুরো বিষয়টিকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অপরাধে অভিযুক্তকে ডিজির বাসায় আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অভিযোগ করা পোস্টগুলো পুরোপুরি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটি কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই এসএসএফের ডিজি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এটি অত্যন্ত দায়িত্বহীন একটি কাজ। এ ধরনের প্রচার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসএসএফ ডিজি ও সংস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টা।

জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান থেকে শুরু করে বাহিনীটির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিষয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। একাধিকবার সেনাপ্রধান ‘গুজবে’ কান না দিয়ে সবাইকে ধৈর্যশীল ও সহযোগী মনোভাব প্রদর্শন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দক্ষ ও পেশাদার সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তিকে নিয়ে গুজব-বিভ্রান্তি যারা ছড়াচ্ছেন সম্ভবত তারা ভুলে গেছেন ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী বিপ্লবকে সফল করতে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক বিশেষণের মর্যাদা আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণ করেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই। বর্তমান সঙ্কটময় মুহুর্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁরা সাহস ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে চলেছে। ছাত্র-সেনা-জনতার শক্ত সেতুবন্ধে রূপান্তরিত হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসও গণঅভ্যুত্থান সফলে সেনাবাহিনীর ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। একাধিকবার তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতির অহংকার ও বিশ্বাসের জায়গা। বরাবরের মতো এবারও দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং পরে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা, শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা দেওয়াসহ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অস্ত্র উদ্ধারসহ সব কার্যক্রমে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দেওয়ার জন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ কিন্তু বোধ বিসর্জন দেওয়া একটি শ্রেণি যেন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছেন। এই চক্রটি গুজব আর সাংবাদিকতাকে এক করে ফেলেছেন। যা দেশের মানুষ ঘৃণাভরেই প্রত্যাখ্যান করেছে।

 এসএসএফ ডিজিকে নিয়ে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিডিও এবং প্রকৃত সত্য

রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার কে ব্লকে এসএসএফ ডিজিসহ তাঁর ১৩ জন কোর্সমেট নিজেদের চাকরি জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ও ঋণের টাকায় যৌথভাবে একটি ভবনটি নির্মাণ করেন। ওই ভবনটি অসংখ্য ভাড়াটিয়া রয়েছেন। সম্প্রতি ওই ভবনটিতে ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেন আলী হোসেন শিশির নামের এক পোশাক কারখানার মালিক। তিনি আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য- এই তথ্য গোপন করে বাসাটি ভাড়া নেন। তিনি নরসিংসদীতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। মাত্র দু’বছর আগে তিনি ঢাকায় আসেন এবং নিজেকে সিআইপি হিসেবেই সব মহলে পরিচয় দিতেন। ওই ভাড়াটিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকের একটি আইনি চুক্তি রয়েছে। ভাড়াটিয়াদের জন্য ডিএমপি’র নির্ধারিত ফরমও পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু কোন ভাড়াটিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় ধুরন্ধর স্বভাবের শিশির একজন ভাড়াটিয়া হিসেবে এই সুযোগটি নিয়েছেন। কিন্তু গত ১৭ জানুয়ারি স্থানীয় একটি রেস্তোরায় একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে প্রথমে দেখতে পান। পরে তাকে অনুসরণ করে তিনি কোন বাড়িতে থাকছেন এই বিষয়টিও নিশ্চিত হন। এরপরই তাকে সম্প্রতি বাসাটি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

স্থানীয় অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা জানান, শিশির ওই বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকলেও তিনি দিব্যি নগরীতে ঘুরে বেড়াতেন। এক্ষেত্রে বাসাটিতে তাঁর লুকিয়ে থাকার তথ্যটিও হাস্যকর। পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার পরিচয় সনাক্তের পর এসএসএফ ডিজি পুলিশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। পুলিশও কখনও দাবি করেনি যে তিনি এই বিষয়ে ন্যূনতম অসহযোগিতা করছেন। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তারের সময় করা ভিডিওটিতে দাবি করা হয়েছে, সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয় দিচ্ছেন। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও অপতথ্য। একইভাবে তারা পুরো ঘটনায় অসৎ উদ্দেশ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকেও জড়িয়েছেন। সমগ্র ঘটনাপ্রবাহে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের দেশপ্রেমিক বাহিনীটির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ঘায়েল করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপতৎপরতা চালিয়েছেন। পাশাপাশি সৎ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক একজন উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মাহবুবুস সামাদ চৌধুরীর বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতেই পরিকল্পিতভাবে নানা কল্পকাহিনীর মাধ্যমে মিথ্যাচার করা হচ্ছে এটাও এখন দিবালোকের মতোই পরিস্কার।

পতিত সরকারের কূপানলে বঞ্চিত হন পদোন্নতি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরি জীবনে মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখলেও পতিত সরকারের রোষানলে পড়েন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মাহবুবুস সামাদ চৌধুরী। একাধিকবার পদোন্নতি বঞ্চিত হন তিনি। গত ৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর তিনি প্রথম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। তিনি পাকিস্তান থেকে স্টাফ কলেজ সম্পন্ন করেন। এর পাশাপাশি মাহবুবুস সামাদ ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর থাকার সময়ে ২০০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি কারফিউ ভঙ্গ করার অপরাধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা টিপু, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাবিক বাদশাসহ কতিপয় নেতাদের গ্রেপ্তার করেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর পদোন্নতি মেলেনি। এমনকি পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ঘটনায় তাঁর ওপর ছিলেন অগ্নিশর্মা। বছর তিনেক আগে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন নিজেও আওয়ামী লীগের একটি অনুষ্ঠানে তাদের গ্রেপ্তারের এই বিষয়টিকে পুনরায় সামনে নিয়ে আসেন। এই ভিডিও এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে ওয়ালে এবং ইউটিউবে। সূত্র মতে, বারবার পদোন্নতি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ মাহবুবুস সামাদ কর্নেল পদে থাকাকালীন ২০১৯ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন। যদিও পরে সেটি গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু তিনি ও তাঁর ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সামাদ পতিত সরকারের কূপানলে পড়েন। গত ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর মাহবুবুস সামাদ চৌধুরী আরাধ্য পদোন্নতি পেয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড.মুহাম্মদ ইউনূস তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ডিজি এসএসএফ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। কিন্তু তাকেই এখন ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে পরিকল্পিত মিথ্যাচারের ঘটনা কল্পনাপ্রসূত ও পর্বতে মুষিক প্রসবের নামান্তর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


আমার বার্তা/এমই