সুবিধাভোগীদের ষড়যন্ত্রের শিকার প্রকৌশলী আফরোজা বেগম

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:৫৩ | অনলাইন সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকৌশলী আফরোজা বেগম : ছবি সংগৃহীত

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিএনপি পরিবারের সন্তান হিসেবে বৈষম্যের শিকার হন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফরোজা বেগম। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশেও তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের অভ্যন্তরে। আলোচনা চলছে কর্মকর্তাদের টেবিলে টেবিলে। অনেকেই বলাবলি করছেন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের রোষানলের শিকার হয়েছেন তিনি।

দেশের বাজেটের অপেক্ষাকৃত বেশি বরাদ্দ শিক্ষা খাতে। আর সে বরাদ্দের বেশিরভাগই খরচ হয় শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে। যার দায়িত্ব পালন করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। এ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর পদটি বৈধ-অবৈধভাবে আয়ের জন্য ‘সোনার হরিণ’।

আগামী ১৯ জানুয়ারির মধ্যে ‘হরিণ’ ধরতে চলছে চতুর্মুখী তদবির। কেউ চায় পদোন্নতিসহ পদ, কেউ চায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আবার ফের সুপারসিট করে বাগাতে চায় পদটি। পদ প্রত্যাশীদের ইচ্ছাপুরণে যারা তদবিরে নেমেছেন তাদের তালিকায় আসছে সমন্বয়ক, রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং আমলাদের নাম।

জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রায়হান বাদশার বিরুদ্ধেও রয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলার নানা অভিযোগ। ছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সদস্যও। দায়িত্ব নেয়ার পরও তার বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়মের নানা অভিযোগ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভালো পদায়নসহ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ। এই পরিষদের সদস্য ছিলেন রায়হান বাদশা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি অবস্থান পাল্টে, রুটিন দায়িত্ব নেন প্রধান প্রকৌশলীর। এছাড়া ২০০৭ সালে ভবন নির্মাণে অনিয়ম, কাজ শেষের আগেই ঠিকাদারকে বিল দেয়ায় সাজাপ্রাপ্ত হন। এরপর যেখানেই চাকরি করছেন সেখানেই তার বিরুদ্ধে উঠে অনিয়মের অভিযোগ।

নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের নতুন ছাত্রীনিবাসের নির্মাণকাজ শেষ হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষকে সেটি বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে ঠিকাদারকে চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করা এবং ভবনটি অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তদন্ত করে ২০০৭ সালের দিকে দুই বছরের জন্য তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে সেই বরখাস্ত প্রত্যাহারের পর একসময় তাকে ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত ১০ জন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, এই কর্মকর্তা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকা সার্কেল এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন ও দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবেও তিনি  পরিচিত। রায়হান বাদশা প্রায় ১০ বছর গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে কর্মরত ছিলেন। প্রত‍্যেকটি কাজের জন‍্য কোটি কোটি টাকা তিনি ঠিকাদারদের এডভান্স দিতেন ও বখরা নিতেন। তিনি ময়মনসিংহে জেলা থাকাকালে দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন।যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, ইইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ ও প্রধান প্রকৌশলী পদ দুটোই শূন‍্য। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ও সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে (এসএসবি) রায়হান বাদশা সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট প্রদান করায় তাকে চাকরিচ্যুত করার জায়গায় ওএসডি করা হয়।

এদিকে জালাল চৌধুরী ও নজরুল হাকিম এদের দূর্নীতি ফাইলগুলি মওকুফ করার ব‍্যবসিথা করেন পতিত সরকারের প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার।

কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, এই পদোন্নতির উদ্যোগের কারণে ইইডিতে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া অনেক কর্মকর্তার দীর্ঘদিন পদোন্নতি হচ্ছে না।  দরপত্র ও ড্রয়িং অনুমোদনেও দেরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ইইডিতে অস্থিরতা ও স্থবিরতা বিরাজ করছে।
সূত্র বলেছে, প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্বে থাকা রায়হান বাদশা বিশাল অংক দাবী করায় তাকে সরানো হয়। আর পতিত সরকারের দোসরপুষ্ট হয়ে কাজ করার জন‍্য তাকে এই দায়িত্বে বসানো হয়েছিল।

জানা গেছে, ২০২২ সালে প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী শাহ্ নইমুল কাদের। তিনি তার সর্বোচ্চ পদের মেয়াদ বাড়ানোর লোভে গঠন করেন ‘শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ’। এ পরিষদের আহ্বায়ক কমিটিতে কোনো আলোচনা ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত করেন প্রকৌশলী আফরোজা বেগমের নাম। যদিও আফরোজা বেগম তখন ময়মনসিংহ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে কমিটিতে নাম রাখার বিষয়ে আপত্তি তোলেন প্রকৌশলী আফরোজা। প্রতিবাদের মুখে তার নাম আহ্বায়ক কমিটির তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার।

এরপর ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেলোয়ার মজুমদার। এর মধ্যে ময়মনসিংহ সার্কেল থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ৪ বছর ৭ মাস পর ২০২৩ সালের ১২ জুলাই প্রধান কার্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন আফরোজা বেগম। তবে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদে তার নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে প্রতিবাদ করায় তাকে কোনো কাজ না দিয়ে ৬ মাস বসিয়ে রাখা হয়। এরপর সবকিছু ঠিকঠাক চললেও আবার বিদায়ী বছরের ২০ নভেম্বর তাকে ওএসডি করা হয়।

আফরোজা বেগম বলেন, ‘আমি বৈষম্যের শিকার হয়েছি। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সব সময় ন্যায়ের পথে থেকে জনস্বার্থে কাজ করার চেষ্টা করেছি। জন-আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিশ্রুত কর্মী এবং সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে ৩১ বছর দায়িত্ব পালন করে চলেছি। জনস্বার্থে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করেছি। আমার বিষয়ে আনীত অভিযোগ মনগড়া, বানোয়াট, অসত্য এবং হীনস্বার্থ চরিতার্থে করা, যা সত্যের অপপ্রলাপ মাত্র।’

তিনি বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নই। ২০১২ সালে আইইবি’র নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। সব সময় বিভাগীয় সুনামের প্রতি লক্ষ রেখেছি। চাকরি জীবনের শেষে এসে আমি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়নে মানসিকভাবে বিড়ম্বনার সম্মুখীন ও মর্মাহত এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’ এজন্য নিয়মিত সম্মানজনক পদে পদায়নের জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, আফরোজা বেগমকে ওএসডি করে রাখায় তারা বিস্মিত হয়েছেন। কারণ বিগত সরকারের সময়ে তিনি ঢাকায় পদায়নের চেষ্টা করেও আসতে পারেননি। তাকে দীর্ঘদিন ময়মনসিংহ সার্কেলে রাখা হয়। আবার পরে ঢাকায় বদলি হয়ে এলেও ৬ মাস তাকে বসিয়ে রাখা হয়।

তারা বলেন, অফিস অর্ডারের বাইরে আফরোজা বেগম কখনো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি। কয়েকজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তার রোষানলে পড়ে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাকে ওএসডি করানোতে তারা সুবিধা পেয়েছেন। এ ঘটনায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় কেউ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না।

এদিকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী পদ ছাড়াও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদটি এক বছরাধিককাল যাবৎ শূন্য রয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অবকাঠামো নির্মাণের কাজে নিয়োজিত এ দফতরের শীর্ষ পদটি ফাঁকা থাকায় স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে জানিয়েছেন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা।

প্রকৌশলী আফরোজা বেগম দীর্ঘ ৩১ বছরের চাকরি জীবনে চট্টগ্রাম এ সহকারী প্রকৌশলী পদে ৩ বছর, নারায়ণগঞ্জ এ সহকারী প্রকৌশলী পদে ২ বছর, লক্ষ্মীপুর নির্বাহী প্রকৌশলী পদে প্রায় ১ বছর, ময়মনসিংহ এ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ৪ বছর সাড়ে ৬ মাস সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। চাকরি জীবনের বেশির ভাগ সময় ডিজাইন শাখায় নিজেই স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও ড্রইং সততার সঙ্গে কাজ করেছেন। সারা দেশে বিভিন্ন ক্যাটাগরির অগণিত বিল্ডিং ডিজাইনের মধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বিল্ডিং, হোস্টেলসহ (তিনটি স্থাপনা-বিল্ডিং) উল্লেখযোগ্য।


আমার বার্তা/এমই