এভসেক ও বিমান বাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টায় বদলে যাচ্ছে শাহ আমানত বিমানবন্দর
বেড়েছে যাত্রী সেবার পরিধি
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ
বিশেষ প্রতিবেদক:
বছরের পর বছর চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও নানান হয়রানির কারণে ভ্রমণ যাত্রীদের জন্য রীতিমতো এক দুঃস্বপ্নের নাম ছিল চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিমানবন্দরকে ঘিরে বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত। কিন্তু গত কয়েক মাসে বদলে যেতে শুরু করেছে বিমানবন্দরটির সার্বিক দৃশ্যপট। গত ৫ আগস্ট জনরোষে বিমানবন্দরটি অরক্ষিত রেখে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) চলে যাওয়ার পর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অনুরোধে নিরাপত্তায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক) এর পাশাপাশি কাজ শুরু করেন বিমান বাহিনীর ২০০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স। এয়ার সাইড ও ল্যান্ড সাইড দু’দিকেই সমানতালেই তখন থেকেই দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী।
এরপর থেকেই এখানে বেড়েছে যাত্রী সেবার পরিধি। যাত্রীদের হয়রানি ঠেকানোর পাশাপাশি চুরি বা লাগেজ কাটার ঘটনাকে শুন্যে নামিয়ে আনতে গ্রহণ করা হয় কঠোর পদক্ষেপ। এভসেক ও বিমান বাহিনীর সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে গত ৫ আগস্টের আগে-পরে এক ঘণ্টার জন্যও বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ বন্ধ হয়নি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বোর্ডিং পাস, ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে পদে পদে প্রবাসীরা হয়রানির শিকার হওয়ার চিরায়ত ঘটনাও এখন আর নেই। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অপারেশন ও বিমানবন্দরের গ্রাউন্ডস হ্যান্ডলিং সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের বিশ্বস্ত মাধ্যমের এতোদিনের অপবাদেরও যেন অবসান ঘটেছে।
দেশের প্রায় ২১ শতাংশ যাত্রী ব্যবহার করেন চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এটিকে বিশ্বমানের ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে তিনটি পর্যায়ে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিমান বন্দরটির বর্তমান পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন শেখ আব্দুল্লাহ আলমগীর। তিনি বলেন, ‘শাহ আমানতের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রায় ৪৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের লাইটিংয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। টার্মিনাল সুবিধা বাড়াতে বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপন করা হচ্ছে, চলমান রয়েছে টার্নিং প্যাড সম্প্রসারণ কাজ। প্যাসেঞ্জার ও কার্গো সিকিউরিটি ব্যবস্থাও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ কাজ চলছে। জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্প সম্পন্ন হলে যাত্রী সম্প্রসারণ ও কার্গো সক্ষমতা বাড়বে।'
যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে দিন-রাত একাকার, কমেছে লাগেজ প্রাপ্তির সময়
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৮টি আন্তর্জাতিক এবং ৪০টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ওঠানামা করে। বছরে মাত্র ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল শাহ আমানত বিমানবন্দর। এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখের বেশিতে। ২০৩০ সাল নাগাদ যা হবে ৩০ লাখ, ২০৪০ সালে ৫০ লাখ এবং ২০৭০ সালে দাঁড়াবে ১ কোটির বেশিতে। এই বিমানবন্দর ২০২৩ সালেই ১৬ লাখ ১০ হাজার ৪২৮ জন যাত্রী বহন করে রেকর্ড গড়ে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ৬ লাখ ৪২ হাজার ৪২৮ জন এবং আন্তর্জাতিক রুটের ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৪ জন। যেখানে ২০২২ সালে বিমানবন্দরটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ১৮ জন যাত্রী বহন করেছিল। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ৫ লাখ ৬১ হাজার ৯৫৪ জন এবং আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রী ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪ জন।
নানাদিক বিবেচনায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের গুরুত্ব বাড়ছে। বিশ্বের সব বন্দরের ব্যাকআপ হিসাবে অত্যাধুনিক এবং বিশ্বমানের বিমান বন্দর থাকার কথা থাকলেও এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বঞ্চিত ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছেই শাহ আমানত বিমানবন্দরের অবস্থান হলেও সুযোগ-সুবিধা সেখানে বিশ্বমানের ছিল না। অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে মনোযোগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের পাশাপাশি যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে দিন-রাত একাকার করে কাজ করে চলেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। একেকজন যাত্রীর লাগেজ প্রাপ্তির সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই মিলছে লাগেজ। বিমানবন্দরে বহু বছর অচল থাকা ফ্রি টেলিফোন বুথও করা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ সচল।
বিমানবাহিনীর টাস্কফোর্সের সহযোগিতায় প্রান্তিক ভবন ও কার পার্কিং এ যাত্রী হয়রানি রোধ করা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে। কোন রকম টানা পার্টির তৎপরতা নেই। সালাম দিয়ে ট্রলিম্যানদের ও আনসার সদস্যদের চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়েছে। উন্নত বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর মতোই এখানে যাত্রীদের সহায়তার জন্য বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। শাহ আমানতে সেবায় সন্তুষ্ট প্রবাসীরাও। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরা এক প্রবাসী শাহ আমানতে এবারের যাত্রীসেবায় মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেন।তিনি বলেন, 'কয়েক মিনিটে লাগেজ পাওয়া, ফ্রি ফোন করা এসব পরিবর্তন আমাদের জন্য আনন্দদায়ক। এমন বিমানবন্দরই চেয়েছিলাম আমরা।'
বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিমান বাহিনীর বিশেষ টাস্কফোর্স
গত ৫ আগস্ট থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আন্তরিক সহযোগিতায় এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক) বিমানবন্দরের প্রবেশ পথ, টার্মিনাল ড্রাইবওয়েতে, এপ্রোন এরিয়াতে প্রবেশের গেইট (৪ নম্বর গেইট), এপ্রোন এলাকা, রানওয়ে ৫ ও ২৩, যাত্রী কারপার্কিং এই পয়েন্টগুলোতে তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ২০০ সদস্যকে অস্থায়ী ভিত্তিতে মোতায়েন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিমানবন্দরের ভেতরে-বাইরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিমান বাহিনীর বিশেষ টাস্কফোর্স ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শাখার সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ কমিটির নেতৃত্বে প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর বিমানবন্দরের প্রতিটি তল্লাশি চৌকি ও জনমানবশূন্য পয়েন্টগুলোতে নিরাপত্তা টহল নিশ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সহযোগিতায় বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এপ্রোন এরিয়ায় প্রবেশের ৪ নম্বর গেইট, রাডার স্টেশন, ভিওআর, ট্রান্সমিটিং স্টেশন, পাওয়ার হাউস, জিপি-লোকারাইজার স্টেশন- এসব পয়েন্টে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রীসেবা প্রদানে বিমানবাহিনীর সদস্যরা প্রান্তিক ভবনের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টসমূহে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বিশেষ করে গত সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আনসার সদস্যরা কর্মবিরতি শুরু করলে বিমান বাহিনী টাস্কফোর্স দক্ষতার সঙ্গে বিমানবন্দরটিকে সুরক্ষিত করে। সেই থেকে দিন-রাত টাস্কফোর্স সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও এভসেক’র সম্মিলিত প্রয়াসে সামগ্রিক কার্যক্রমে পরিবর্তনের সূত্রপাত করেছে। ইতোমধ্যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিমানবন্দরটি। জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, 'যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন ছিল আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। আপনি নিজেও বিমানবন্দর ব্যবহার করার সময় বুঝতে পারবেন, আগের চেয়ে এখন যাত্রীসেবার মানের পার্থক্য কতটুকু। যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে দিন-রাত কাজ করেছি। এখনও কাজ করে যাচ্ছি। এটা এখন শুধু আমাদের কথা নয়, বিমানবন্দর ব্যবহার করা দেশি-বিদেশি যাত্রীরাই বলছেন, যাত্রীসেবার মান অনেক বেড়েছে।'
তিনি বলেন, 'বিমানবন্দরে যাত্রী সেবা নিশ্চিত হলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। বিমান বাহিনী, এভসেক, এপিবিএন বা আনসার যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছে। আমরা সব বিষয়ে সজাগ রয়েছি। কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে না।'
আমার বার্তা/এমই