প্রিয়নবীকে ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত: আবু আইয়ুব আনসারীর আতিথেয়তা
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৫২ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

ইসলামের ইতিহাসে হিজরত এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মক্কা থেকে মদিনায় মহানবী (স.)-এর আগমনের দিনটি ছিল মদিনাবাসীর জন্য এক পরম আনন্দ ও সৌভাগ্যের মুহূর্ত। নবীজিকে (স.) এক পলক দেখার জন্য মদিনার অলিগলি, রাস্তা-ঘাট ও বাড়ির ছাদে ভিড় জমিয়েছিল নারী, পুরুষ, শিশুসহ সব শ্রেণির মানুষ। তাকবির ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল চারপাশ। শিশুরা গেয়ে ওঠেছিল, ‘ওই দেখো, আমাদের আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে! আল্লাহর পথে আহ্বানকারী যতদিন আহ্বান করবে, ততদিন কৃতজ্ঞতা আদায় করা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে প্রেরিত হে মহান রাসুল! আপনি এসেছেন এমন বিষয় নিয়ে, যা আমাদের অনুসরণ করতেই হবে।’ (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ২/২৪)
মদিনা অভিমুখে যাত্রা ও নবুয়তের পথনির্দেশ
রাসুলুল্লাহ (স.) কুবায় কয়েক দিন অবস্থান করার পর মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন এবং সন্ধ্যায় মদিনায় প্রবেশ করেন। তাঁর উটনি সামনে এগোতে থাকলে প্রত্যেক সাহাবি আশা করছিলেন, নবীজি (স.) তাঁর বাড়িতে অতিথি হবেন। তাঁরা আবেগাপ্লুত হয়ে তাঁর উটনির লাগাম ধরে গতিরোধ করতে চাইছিলেন। তখন মহানবী (স.) বলেন, ‘তোমরা উটনির পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত।’
উটনিটি চলতে চলতে বনু নাজ্জারের বসতিতে এসে থেমে যায়। এটি ছিল নবী (স.)-এর নানাদের বসতি। তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ! এটাই হবে আমাদের মানজিল।’ তখন বনু নাজ্জারের কিশোর-কিশোরীরা তাঁর সম্মানে আবৃত্তি করে- ‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের মেয়েরা, কত খুশি ও আনন্দের কথা যে মুহাম্মদ (স.) আমাদের প্রতিবেশী হয়েছেন।’ তাদের এই ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে নবী কারিম (স.) বলেন, ‘আল্লাহ জানেন আমি তোমাদের ভালোবাসি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৮৯৯)
আবু আইয়ুব আনসারীর অনন্য আতিথেয়তা
নবীজি (স.)-এর উটনি যেখানে থেমেছিল, সেখানেই ছিল আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ি। যদিও বনু নাজ্জারের লোকেরা তাঁকে অতিথি হিসেবে পাওয়ার আবেদন করেছিল, কিন্তু উটনির থামার কারণে আবু আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর আবেদনই কবুল করা হয়। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১৮৩ ও ১৮৯)।
আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িটি ছিল দোতলা। রাসুল (স.) নিচতলায় থাকতে মনস্থির করেন। কিন্তু নবীকে (স.) নিচে রেখে নিজে দোতলায় থাকা আবু আইয়ুবের বিবেকে বাঁধছিল। তিনি রাসুল (স.)-কে দোতলায় থাকার অনুরোধ করেন। জবাবে নবীজি (স.) বলেন, ‘আবু আইয়ুব, আমি আমার ও আমার সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য নিচতলায় থাকাকেই সুবিধাজনক মনে করি।’
আর্থিকভাবে সচ্ছল না হলেও আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) নবীজি (স.)-এর আদর-আপ্যায়ন ও সেবা-যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করে পাঠাতাম। কোনো খাবার ‘অবশিষ্ট’ ফিরলে আমি ও আমার স্ত্রী তা যেখানে নবীজি (স.) মুখ লাগিয়ে খেয়েছেন, সেখান থেকে খেয়ে নিতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘একবার রাতে পানির পাত্র ভেঙে গিয়েছিল, তখন আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের একমাত্র পরিধেয় চাদর দিয়ে পানি মুছে নিলাম, যেন পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কষ্টের কারণ না হয়।’ নবীজি (স.) আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর ঘরে সাত মাস অবস্থান করেন। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা-২০২ ও ২০৪)
আবু আইয়ুবের এই নবীপ্রেমের আরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের বর্ণনা দিয়েছেন প্রসিদ্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। তিনি বলেন, একবার রাসুল (স.), আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ও ওমর (রা.) প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে রোদ্রমুখর দুপুরে আবু আইয়ুব আনসারির বাড়িতে যান। আবু আইয়ুব (রা.) তখন পাশের এক খেজুর বাগানে কাজ করছিলেন। রাসুল (স.)-এর আওয়াজ শুনেই তিনি ছুটে আসেন। অপ্রত্যাশিতভাবে মেহমান নিয়ে রাসুল (স.)-এর আগমনে তিনি দ্রুত খেজুর বাগানে গিয়ে একটি খেজুরের কাঁদি কেটে আনেন। কাঁদিতে কাঁচা, পাকা, আধা-পাকা সব ধরনের খেজুর ছিল। রাসুল (স.) এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি চাই আপনি আপনার পছন্দের খেজুর গ্রহণ করুন। আমি জানি না, এই মুহূর্তে আপনার কোন ধরনের খেজুর বেশি পছন্দ, তাই সব ধরনের খেজুরের একটি কাঁদি কেটে এনেছি।’ এরপর তিনি একটি ছাগলছানা জবাই করে তার অর্ধেক রসালো করে এবং বাকি অর্ধেক দিয়ে কাবাব তৈরি করে পরিবেশন করেন। এখানেও তিনি রাসুল (স.)-এর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫১৯৩)
মসজিদে নববি নির্মাণ: এক ঐতিহাসিক স্মৃতি
যেখানে আল্লাহর নির্দেশে উটনি বসে পড়েছিল, সেখানেই প্রিয়নবীর অংশগ্রহণে নির্মাণ করা হয় মসজিদে নববি। জায়গাটির মালিক ছিল সাহল ও সুহাইল নামক দুই এতিম বালক। তারা ছিল নবীজি (স.)-এর মাতৃকুলের আত্মীয়। মসজিদ নির্মাণের জন্য নবী (স.) জায়গাটি নিতে চাইলে বালকদ্বয় তা দান করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু নবীজি (স.) উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করেই তা গ্রহণ করেন। তিনি আবু বকর (রা.)-কে মূল্য পরিশোধের নির্দেশ দিলে তিনি তাদের জমির বিনিময়ে ১০ দিনার প্রদান করেন।
মসজিদ নির্মাণের আগে জায়গাটিতে খেজুর শুকানো হতো। সেখানে কিছু খেজুর ও অন্য গাছ ছিল, এমনকি মুশরিকদের কয়েকটি কবরও ছিল। মহানবী (স.) গাছ কেটে, কবর ভেঙে স্থানটিকে সমতল করার নির্দেশ দেন। (সিরাতে মোস্তফা: ১/৪০৯)।