সিবিএ নেতা সারোয়ার যেন এক মোগল সম্রাট
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৪, ১৫:০৩ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
* আত্মীয়-স্বজনসহ প্রায় ৪০০ লোককে চাকরি দিয়েছেন
* নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা
বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ নেতা সারোয়ার হোসাইন যেন এম মোগল সম্রাট। নামে-বেনামে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। শুধু তাই নয়, প্রায় অর্ধশত আত্মীয়-স্বজনসহ ৪০০ জনের চাকরি হয়েছে তারই হস্তক্ষেপে। বিএনপিপন্থি সোনালী ব্যাংকের পয়াত সিবিএ নেতা বাকির হোসাইনকেও যেন হার মানিয়েছেন তিনি। বিএনপি নেতা শিমুল বিশ্বাস এবং বাকিরের আদর্শে অনুপ্রাণিত সারোয়ার হোসাইন এখন বিআইডব্লিউটিএর সরকারি দলের সিবিএ নেতা।
অভিযোগ উঠেছে, বিআইডব্লিউটিএতে বিএনপিপন্থি কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং এই সিবিএ নেতার যোগসাজশে সংস্থাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। কর্তৃপক্ষও অজ্ঞাত কারণে সারোয়ার হোসাইনের রাজনৈতিক আদর্শ খতিয়ে দেখছেন না। অবৈধ আয়ের মাধ্যমে ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা চলছে। তিনি পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়ে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলেছেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। সারোয়ার হোসাইন নিজেও একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। সিবিএ নেতা হওয়ার বদৌলতে অসম্ভবকে সম্ভব করে সংস্থায় একচ্ছত্র কায়েম করেছেন এই নেতা। তিনি এতই ক্ষমতাধর যে, শ্যালকের চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে গেলেও তাকেও চাকরি দিতে সক্ষম হয়েছেন। স্ত্রী কামরুন নাহার মলি ট্রেসার পদে চাকরি করেন। কিন্তু স্বামী সিবিএ নেতা হওয়ায় তিনি অফিস না করেই শুধু হাজিরা খাতায় সই করে মাসিক বেতন-ভাতা ভোগ করছেন বলে অভিযোগে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন বি-২১৭৬ এর সাধারণ সম্পাদক (মেয়াদোত্তীর্ণ) হলেন সারোয়ার হোসাইন। এক বছর আগেই আবুল-সারোয়ারের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলা থাকার দোহাই দিয়ে ইলেকশন দিচ্ছেন না। সারোয়ার হোসাইন সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন প্রায় এক বছর ধরে। এর আগে তিনি সংগঠনটির কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। সিবিএর প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রফিকুল ইসলাম, তিনি অবসরে যাওয়ার পর সবাইকে ম্যানেজ করে সারোয়ার হোসাইন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তা ছাড়া এই জুটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় প্রায় ১৮শ’ কর্মচারীর অধিকাংশই তাদের উপর ক্ষুব্ধ। ইলেকশন দিলে সারোয়ার হোসাইন এই পদে আর বহাল থাকতে পারবেন না। কারণ তার দুর্নীতির পরিমাণ এতই বেশি যে, যা কর্মচারীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে উপরের স্যারদের সাথে সারোয়ার হোসাইনের বেশ সখ্য থাকায় দুদকের মামলাসহ সব অনিয়ম-দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তেই আছেন। বিআইডব্লিটএর কর্মচারীদের প্রশ্ন, একজন সিবিএ নেতার নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, ধন-সম্পদ এবং ব্যাংক ব্যালেন্সের অভিযোগ। দুর্নীতিপরায়ণ এই ব্যক্তির কাছ থেকে সাধারণ কর্মচারীরা কি আশা করতে পারেন। তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা থাকা সত্ত্বে¡ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উপরন্তু সারোয়ার হোসাইনের প্রতিনিয়ত ডিমান্ড বাড়ছেই বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ, বদলি ও ইজারা ঘাটসহ বিভিন্ন তদবিরে মন্ত্রীর নাম ব্যবহারও করেন এই সিবিএ নেতা। যা মন্ত্রী নিজেও অবগত নন। তবে মন্ত্রীর একজন এপিএস তাকে সর্বদা সহযোগিতা করেন এমন গুঞ্জন আছে মতিঝিলস্থ বিআইডব্লিউটিএ ভবনে। ওই এপিএস সারোয়ার হোসাইনের আস্থাভাজন হয়ে নিজেও এখন অনেক ধন-সম্পদের মালিক। গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, বিএনপি নেতা শিমুল বিশ্বাস এবং সোনালী ব্যাংকের বাকির হোসাইনের (প্রয়াত) হাত ধরেই সারোয়ার হোসাইনের উত্থান। একটি সূত্রমতে, বিআইডব্লিউটিএতে বেশ কয়েকজন উচ্চ০পদস্থ কর্মকর্তা বিএনপিপন্থি। গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও তাদের সম্পর্কে প্রতিবেদন আছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সারোয়ার হোসাইনের প্রাণের শ্যালিকা যুক্তরাজ্য প্রবাসী নুরুন্নাহার পারভিনের নামে রাজধানীর খিলগাঁও, চৌধুরীপাড়া, মাটির মসজিদ সংলগ্ন বি-১০৮ নম্বর বাড়ির সপ্তম তলায় প্রায় কোটি টাকা খরচ ১৬শ’ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন সারোয়ার। বর্তমানে সপরিবারে সেখানেই বসবাস করেন তিনি। নিজের টাকায় কেনা এই অট্টালিকা ফ্ল্যাটটি শ্যালিকার টাকায় ক্রয় করা হয়েছে বলে সারোয়ার হোসাইনের দাবি। তিনি কেয়ারটেকার হিসেবে থাকেন শুধু। টাঙ্গাইলের কাগমাড়ায় (কাইয়্যামাড়া) কোটি টাকা খরচ করে জমিও ক্রয় করেছেন তিনি। সেখানে ‘সারোয়ার তাজমহল’ নামে একটি অত্যাধুনিক বাড়ি করার সব সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সারোয়ার হোসাইনের অবৈধ ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিদেশে টাকা পাচারের ফিরিস্তি আগামী পর্বে প্রকাশিত হবে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দেলডা গ্রামে সারোয়ার হোসাইনের বাড়ি। সেখানে বাপ-দাদার আমল থেকেই চরাঞ্চলে বেশ জমাজমি আছে। সারোয়ার হোসাইন এলাকার মানুষের কাছে দানবীর এবং জনদরদি হিসেবে পরিচিত। চাকরিসহ বিভিন্ন আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন সারোয়ার হোসাইন। তবে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে নগদ টাকা নিয়ে চাকরি দেন। সিবিএ নেতা সারোয়ার হোসেন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যাদের চাকরি দিয়েছেন তারা হলেন- স্ত্রী কামরুন নাহার মলি, পদবি ট্রেসার। আপন ফুফাতো ভাই আব্বাস আলী। আপন মামাতো ভাই আশরাফ। আপন চাচাতো শ্যালক আহসানুল হক কাইয়ুম, পদবি শুল্ক আদায়কারী।
চাচাতো ভাই শামসুল আলম মনি। আপন খালু আব্দুল জলিল, পদবি শুল্ক আদায়কারী। ভাবি নাজমা বেগম, পদবি সহকারী। খালাতো ভাই আনিসুর রহমান, পদবি শুল্ক আদায়কারী। আপন ভাতিজির জামাই তাইজুল, পদবি ট্রেসার। আপন খালাতো ভাই আনু, পদবি সহকারী। আপন মামা ইউসুফ। চাচাতো শ্যালক কাইয়ুমের স্ত্রী রুমেনা আক্তার, পদবি নিম্নমান সহকারী। আপন খালাতো ভাই নজরুল ইসলাম, পদবি গাড়িচালক। চাচাতো ভাই মোজাফফর হোসেন, পদবি অফিস সহায়ক। আপন খালাতো ভাতিজা আরশাদ, পদবি অফিস সহায়ক। আপন ভাতিজা আতিক হাসান, পদবি অফিস সহায়ক। চাচতো ভাতিজা আতোয়ার রহমান, পদবি অফিস সহায়ক। ভাতিজা হযরত আলী, পদবি টার্মিনাল গার্ড। আপন ভাতিজা জুয়েল রানা, পদবি টিসি। ফুফাতো ভাই আজগর, পদবি নিম্নমান সহকারী। ভাগিনা আনারুল ইসলাম, রেকর্ড কিপার। ভাতিজা সোহেল রানা, পদবি পাইলট। চাচাতো ভাতিজা আব্দুল মালেক, পদবি লস্কর। ভাতিজা হাসান, পদবি অফিস সহায়ক। চাচাতো ভাতিজা হযরত আলী, পদবি টার্মিনাল গার্ড। চাচাতো ভাতিজা শান্ত, পদবি লস্কর। ভাতিজা সবুজ শেখ, পদবি লস্কর। ভাতিজা মশিউর রহমান, পদবি গ্রিজার। ভাতিজা হাফিজুল ইসলাম, পদবি গ্রিজার। ভাতিজা ইমরান হাসান, পদবি গ্রিজার। ভাতিজা আতিকুর রহমান পদবি মার্কম্যান। ভাতিজা আল আমিন, পদবি মার্কম্যান। ভাতিজা জামাল, পদবি অফিস সহায়ক। তিনি চেয়ারম্যানের দপ্তরে কর্মরত আছেন। ভাগিনা জিয়াউর রহমান, পদবি নিম্নমান সহকারী। মামতো ভাইয়ের ছেল আবদুল্লাহ, (অনিক), পদবি সহকারী। মামাতো ভাই আনিছুর রহমান, পদবি শুল্ক প্রহরী এবং ভাগিনা শামিম, পদবি ট্রাফিক। তিনি সুপারভাইজার পদে অবৈধভাবে অফিসে নিম্নমান সহকারী ডিউটি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও নোয়াখালী বেল্টের প্রায় ২০০ লোকের চাকরি দিয়েছেন সিবিএ নেতা সারোয়ার হোসেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ লোকের চাকরি হয়েছে এই সিবিএ নেতার হস্তক্ষেপে। তার অনুসারীরা চাকরির বিষয়টি পজেটিভ দেখছেন। তবে এতগুলো মানুষের চাকরি দিয়ে বিআইডব্লিটিএতে নজির স্থাপন করেছেন তিনি।
শ্রমিক ইউনিয়নের মেয়াদ শেষ ও আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি এবং বিএনপি নেতা শিমুল বিশ্বাস ও সিবিএ নেতা বাকির হোসাইনের (প্রয়াত ) সাথে সারোয়ার হোসাইনের সম্পর্ক ছিল, এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো জবাব মেলেনি। সারোয়ার হোসাইনকে ফোন করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে লিখেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।