কঠোর অবস্থানে সরকার

আজ গণপদযাত্রা ও রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি পেশ

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ | অনলাইন সংস্করণ

  শাহীন আলম

* কোটা আন্দোলন নিয়ে মন্ত্রীদের অবস্থান স্পষ্ট
* মামলা প্রত্যাহারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
* আন্দোলন অন্যদিকে ধাবিত করার চেষ্টা চলছে গোয়েন্দা পুলিশ
* ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেবে না ছাত্রলীগ


কোটা সংস্কার আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। নিজেদের দাবি থেকে একচুলও না নড়ার প্রত্যয় তাদের। বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ বিষয়ে আন্দোলনের কোনো যুক্তি নেই উল্লেখ করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে অবশ্য হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, সরকার ইচ্ছা করলে পরিবর্তন করতে পারে। আদালত এটি জানালেও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর মুখে এটা নিয়ে আলোচনায় বসার কোনো ইঙ্গিত নেই; বরং এই আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন ক্ষমতাসীনরা। কোটা আন্দোলনকে আর প্রশ্রয় দিতে চায় না সরকার। এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর কথায় সেটিই উঠে এসেছে। আন্দোলন যাতে আর এগোতে না পারে সে জন্য পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলাও দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে কোটা বিরোধীদের আন্দোলন নিয়ে সরকারের অবস্থান কঠোর।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমি মনে করি, তাদের অপেক্ষা করা উচিত। আন্দোলন থামানো উচিত। কারণ পৃথিবীর সব জায়গাতেই কোটা রয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোটা নিয়ে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের পর কোটা নিয়ে সরকারের কমিশন গঠনের কোনো সুযোগ নেই। কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মাঠে নেমেছে ছাত্রলীগ। মাঠে নেমেছে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছেন, কোটা আন্দোলনের ঘটনাটি অন্যদিকে ধাবিত করার চেষ্টা চলছে। এতে অনুপ্রবেশকারীরা জড়িত রয়েছে।

সরকার যাই বলুক না কেন, ছাত্ররা তাদের এই আন্দোলন নিয়ে এখনো মাঠ থেকে সরে দাঁড়াননি। নতুন কর্মসূচি হিসেবে গণপদযাত্রা ও রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেবেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের নেতারা। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।

কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে এই গণপদযাত্রা শুরু হবে। গণপদযাত্রা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে গিয়ে সেখানে স্মারকলিপি দেবে। গণপদযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ, শেরেবাংলা কলেজসহ ঢাকার আন্দোলন সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করবে বলে জানান নেতারা। একই সাথে মামলা প্রত্যাহারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়ায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এতে কোটা ফিরলে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে ঘোষিত এক দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটা ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছে।

আন্দোলন রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের অন্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই সড়ক অবরোধ করছেন। দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে হাইকোর্টের রায়ের ওপর এক মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের মূল অংশ প্রকাশ করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা বাড়াতে বা কমাতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ দেয়া যাবে। কিন্তু এরপরও আন্দোলন থেকে সরেননি শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার করে সংসদে আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

শুরুতে কিছু না বললেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে আর ভালো চোখে দেখছে না সরকার। আদালতের রায়কে শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে বলেই মনে করছেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। তারা বলছেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী আদালতের সিদ্ধান্ত দেয়ার পরও আন্দোলন অব্যাহত রাখা অস্বাভাবিক এবং এর পেছনে অন্যকিছু আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র মন্ত্রী আমার বার্তাকে জানান, বিএনপি ও তাদের মিত্ররা এ আন্দোলনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সরকার আন্দোলনে তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের লেখাপাড়ায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্দোলনের বিষয়ে পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এদিকে গতকাল শনিবার ময়মনসিংহে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, রাস্তা বন্ধ না করে প্রধান বিচারপতির আহ্বানে আদালতে আসতে হবে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের।

তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি, তাদের অপেক্ষা করা উচিত। আন্দোলন থামানো উচিত। কারণ পৃথিবীর সব জায়গাতেই কোটা রয়েছে। যেমনÑ আমাদের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জন্য কিছু কোটা রয়েছে এবং সংবিধানেও সেটি বলা আছে। এই ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর কোটা যদি বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে এরা কোনোদিন মূল স্রোতে একত্রিত হতে পারবে না।

অপরদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি ও বক্তব্যকে সংবিধান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কোটা নিয়ে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোটার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি কুচক্রী মহল কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর কোটা না থাকায় সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ হতাশাজনক। পিছিয়ে পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও। মন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কোটায় নিয়োগ সবচেয়ে কম। ভারতে ৬০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালে ৪৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৫০ শতাংশ চাকরিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে ৬০ শতাংশ কোটা চালু রয়েছে।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেছেন, আন্দোলন নিয়ে কাউকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেয়া হবে না। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টায় সরকারি চাকরিতে ‘কোটা’ ইস্যু নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা সংগ্রহ, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংবলিত লিফলেট বিতরণ, উন্মুক্ত আলাপন, যৌক্তিক উপায় নেয়া এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করার জন্য ‘পলিসি অ্যাডভোকেসি’ ও ‘ডোর টু ডোর’ ক্যাম্পেইনের ওপর আলোকপাতের উদ্দেশে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।

আর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘কোটার বিরোধিতা করে কিছু লোক, কিছু শিক্ষার্থী রাস্তায় আন্দোলন করছে। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্ট সবার ভরসাস্থল। আদালতের নির্দেশনা সবার মেনে চলা উচিত। কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না গিয়ে বিভিন্ন সড়কে বসে সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। অনেক জায়গায় গাড়িতে তারা হাত দিচ্ছে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্য কেউ ইন্ধন দিচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, ‘আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। এসব নিয়ে ডিবির টিম ও পুলিশ কাজ করছে।’


আমার বার্তা/জেএইচ