ধরাছোঁয়ার বাইরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শেখ পরিবারের সদস্যরা

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:০৯ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

আমির হোসেন আমু, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলালউদ্দিন, শেখ ফজলে নূর তাপস ও মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দলের সভাপতি ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ওই দিনই ভারতে চলে যান। এরপর দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান দেশে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও চার মেয়াদের বিভিন্ন সময় দায়িত্বে থাকা সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সাবেক সরকারের অনেক এমপি-মন্ত্রীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতাই এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে গত সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বৃহত্তর শেখ পরিবারের সদস্যরা।

শেখ হাসিনার স্বজনেরা গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, মেয়রসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় ছিলেন। এমপি হয়েছিলেন প্রায় ১৫ জন।

এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের মেয়র তিনজন, সহযোগী সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনজন। আওয়ামী লীগের পুরো মেয়াদে সরকার থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখনো তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। ৫ আগস্টের পরে একাধিকবার ফেসবুকে লাইভে এসে বিভিন্ন কথা বলেছেন। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক মহাপরিচালক। তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন।

পুতুলের শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তিনি দুই মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সরিয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হন তিনি। আলোচনায় আছে, সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ছিটকে গেছেন খন্দকার মোশাররফ। তিনি বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে আছেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে ৫ আগস্টই ভারতে চলে যান। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তাঁর ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) পরিচালিত হয়। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ সংসদ সদস্য। আরেক মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। তাঁরা সবাই ব্রিটেনে আছেন বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের একাধিক পাওয়ার হাউস গড়ে উঠেছিল। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন শেখ রেহানার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন ব্যবহার করে দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

ওই নেতা আরও বলেন, আরেকটি পাওয়ার হাউস গড়ে উঠেছিল শেখ হেলালকে কেন্দ্র করে। তাঁরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরের বড় বড় ঠিকাদারিকাজের নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তারিক আহমেদ আত্মগোপনে আছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের পাঁচ ছেলে। তাঁরা খুলনা বিভাগের অঘোষিত অভিভাবক ছিলেন। নির্বাচনে প্রার্থিতা নির্ধারণ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যবসা-বাণিজ্যে তাঁদের ছিল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। তাঁদের মধ্যে দুজন গত সংসদেও এমপি ছিলেন। তাঁরা হলেন শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়ও গত দুই সংসদের এমপি। হেলাল ও তন্ময় ভারতে আছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পরে জুয়েল দেশে ছিলেন। তাঁদের আরও তিন ভাই শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল কোথায় আছেন কেউ জানে না।

শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তাঁর দুই ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও নাইম। পারিবারিক পরিচয়ে ফাহিম বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে শেখ সেলিমের পরিবার আত্মগোপনে আছেন। একটি সূত্রের দাবি, শেখ সেলিম এখনো দেশেই আছেন

শেখ সেলিমের ভাই শেখ ফজলুল হক মণির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। পারিবারিক পরিচয়ে হঠাৎ করেই ২০১৯ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান হন পরশ। ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁর খোঁজ নেই। আর শেখ তাপস ঢাকার সাবেক এমপি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। সরকার পতনের দুই দিন আগে সিঙ্গাপুর যান তিনি।

শেখ সেলিমের ছোট ভাই শেখ ফজলুর রহমান মারুফ ক্যাসিনো বিতর্কের সময় আলোচনায় এসেছিলেন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে আছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। তাঁর ভগ্নিপতি যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীও আত্মগোপনে আছেন।

শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল-১ আসনের এমপি ছিলেন। তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ ছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় এই পরিবার ছিল বরিশাল অঞ্চলের হর্তাকর্তা। ৫ আগস্টের পরে হাসানাত আবদুল্লাহ ও ছোট ছেলে সুকান্ত আবদুল্লাহ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে। তবে সাদিক আবদুল্লাহ কোথায় আছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাঁর ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। তিনি কোথায় আছেন জানা যাচ্ছে না।

শেখ হাসিনার ফুফাতো বোন শেখ ফাতেমা বেগমের এক ছেলে নূর-ই আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন। আরেক ছেলে মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসন থেকে টানা তিনবারের স্বতন্ত্র এমপি ছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এই দুই ভাইও আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা ওয়াসার বিতর্কিত এমডি তাকসিম এ খান তাঁদের ফুফা। তিনি ৫ আগস্টের পরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে আলোচনা আছে।

শেখ পরিবারের আরেক প্রভাবশালী সদস্য বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই শেখ কবির হোসেন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও বাংলাদেশ বিমা সমিতির সভাপতি ছিলেন। তাঁর ভাই শেখ নাদির হোসেন মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান ছিলেন। আরেক চাচাতো ভাই শেখ হাফিজুর রহমান বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্যসচিব। ৫ আগস্টের পর তাঁদেরও কোথাও দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বঙ্গবন্ধুর চাচাতো বোন ফিরোজা বেগমের স্বামী। ৫ আগস্টের পর তিনি ভারত গেছেন বলে গুঞ্জন আছে। তবে সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। সূত্র: আজকের পত্রিকা


আমার বার্তা/এমই