আমেরিকান বন্ধুর গল্প এবং অর্গানিক চাষসহ একটি মডেল গ্রামের একী হাল!
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ
মিঞা জামশেদ উদ্দীন:

ঘর থেকে বের হয়ে আওড়াতে থাকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর একটি কবিতার পংক্তিমালা। " ঘর থেকে দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীর্ষের উপরে একটি শিশির বিন্দু "। হ্যাঁ, তাইতো সত্য প্রতিফলিত হলো বন্ধু ঝুলন সেনের বেলায়। সবই যেন বন্ধুর মিরাকল। সর্বশেষে ১০/৯/২০২৫ ইং ঝুলনের মেজভাই, বৌদি ও তাদের দুই মেয়ে আমেরিকা পাড়ি জমালেন। থেকে গেল তাদের বড়ভাই ভোলা সেন ও ভোলা সেনের পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগে আক্রান্ত স্ত্রী ও ঝুলন সেনের ৪র্থ ভাই রতন সেনের স্ত্রী ও তাদের একমাত্র ছেলে। ঝুলনের বড়ভাই ভোলা সেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাই সঙ্গত কারণে আমেরিকা যাওয়া হবে না; ঝুলনের ছোট দুই ভাই লাতু সেন সপরিবারে এবং রতন সেন স্ত্রী ও সন্তান ছাড়া গত মাস তিনেক আগে আমেরিকা পাড়ি জমায়। তারা এখন ভালোভাবে কর্মতে নিয়োজিত আছেন। ঝুলনের স্ত্রী দীপ্তি সেন সর্বশেষ স্কুল সিকিউরিটি পুলিশ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বুদ্ধিদীপ্ত ও বিচক্ষণতায় বন্ধু ঝুলনের প্রসংশার কমতি নেই। এখন তার চাকরির শেষ দিকে অর্থাৎ ২০২৮-২৯ সালের মধ্যে অবসরে যাবে। অন্তত ওইসময় থেকে স্ত্রী দীপ্তি সেন একটি চাকরিতে নিয়োজিত থাকবে। তাদের ১ ছেলে ২ মেয়ে। বড় মেয়ে একজন চিকিৎসক। ছোই দুই ছেলে-মেয়ে অধ্যায়নরত। ঝুলনকে সন্তানদের জন্য এখন দুশ্চিন্তা করতে হয় না। তারাও ওইখানকার লাইফ স্টাইল ফলো করে অর্থাৎ ছেলে-মেয়েরা যার যার মতো করে থাকতে পছন্দ করে। ঝুলনও তা দেখে অবস্তু হয়ে উঠেছে। ঝুলনও বন্ধুকে আক্ষেপ করে বলে, আমাদের সেন পরিবার এখন রয়েল ফ্যামিলি। সে এক এক সকল ভাইদের পরিবারসহ স্বজনদের আমেরিকাতে এনে স্থায়ী প্রতিষ্ঠিত করে দিলেন। এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। ঝুলনের কিছু স্মৃতি এখনো চোখে ভেসে ওঠে। আমরা দুই বন্ধু একসাথে আমেরিকার ডিবি লটারি ফরম পুরন করি। তবে ডিবি লটারিতে আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না, ঝুলনের পিঠাপিঠিতে তা করা হয়। যাক, ভাগ্যের লটারি ঝুলনের কোপালে জুড়ে। আর এজন্য তাকেও কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি। তার মায়ের একমাত্র সৎ ভাইও ভাগিনা ঝুলনকে আমেরিকা আসতে অর্থনৈতিকভাবে বহু সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তবে আমার তেমন একটা কর্ম ছিলোনা তার জন্য। সর্বশেষ এসে ঠেকে গেল ঝুলন; হয়তো তার আমেরিকা যাওয়ার পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় সে প্রথমে জানায়নি ? পরক্ষণে একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কান্না শুরু করে দেয় এবং একপর্যায়ে বলতে থাকে তার নিকট আত্মীয় বলতে কেউ আমেরিকায় থাকে না, তাকে যে স্পন্সর করবে? তার এ বিষয়টি আমার কাছে বড়ই পীড়াদায়ক মনে হলো। তাকে শান্তনা দিতে থাকি এবং বলি, আচ্ছা বন্ধু ধৈর্য্য ধর, দেখি কি করতে পারি;
ছাত্র বয়স থেকে আমার মাথায় ম্যাজিক বুদ্ধি কাজ করতো; যে কোনো সমস্যায় পড়লে ঠেকিয়ে দেয়াটা কঠিন কাজ ছিলোনা। এরপর থেকে বন্ধু জন্য ভাবতে লাগলাম- কি করি কি করি; আমাদের পরিচয়জনের মধ্যে কেউ আছে কিনা আমেরিকায় খোঁজখবর নিতে লাগলাম। অবশেষে একজনের খোঁজ মিলে। সেও আবার বয়সে বালক। তার বড়বোন পাকি আমার ক্লাসমেট। তাকে আমি বড় বোনের সাথে আসলে দেখেছি এবং বহুবার কলেজে চকলেট খাইয়েছি। তার নাম মিল্টন রহমান। মিল্টনেরও খেয়ালীপনা সাংবাদিক হওয়ার। সে সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তার মেজ চাচা আবুল কাসেম ওয়াহেদী সীতাকুণ্ড বাজারের প্রভাবশালী ব্যাক্তি। সীতাকুণ্ড বাজার কমিটির কয়েকবার সভাপতি ছিলেন।
মিল্টনের শারীরিক গঠনে কালো লিকলিকে-চিকন, হাত-পা বাঁশের কনছির মতো সরু। সবসময়ে হাফ হাতার সার্ট-গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরা থাকতো। তার মেজ চাচা ওয়াহেদী আমেরিকা থাকতেন। আমি তাকে টার্গেট করি এবং তাকে খাইয়ে দায়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলি। মিল্টনও রাজি হলো এবং তার চাচাকে ফোন করে বিষয়টি জানালো। মিল্টন হাজারো হলো বড়ভাইর চেলে। তার কথা শোনে মেজ চাচা স্পেন্সার হতে রাজি হন এবং ডিভি লটারির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাটাতে। এরপর পরানে পানি আসে আমাদের। ঝুলন আমেরিকা গেল। স্ত্রী ও সন্তানেরা আমেরিকার সিটিজেন। অতঃপর তার ভাই এবং ভাইদের স্ত্রী ও সন্তানেরা আমেরিকা বাসী। তারা স্মরণে রাখবে কি-না তা বড় কথা নয়, এভাবে যাত্রা শুরু হয় জীবনের এবং জীবনের অনেক ঘটনা-রটনা। ঝুলন দেশে আসলে খবরা-খবর রাখে। একবার আসতে আমেরিকা থেকে একটি বলপেন নিয়ে আসে এবং সেটি গিফট হিসেবে আমাকে দেয়। এ বলপেন দিয়ে অনেকদিন লেখেছি, এখনো লেখালেখি চলছি।
এবার আরো কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়া। সামনে চোখে পড়বে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান। তার পাশঘেঁষে যেতেই ডানে আমাদের স্কুলটি। এ বিদ্যালয়ে কাটে শৈশব ও কিশোর বয়সের অনেক স্মৃতি। এ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। আমাদের গ্রামটি ঢাকা- মহাসড়ক লাগোয়া পশ্চিম পাশে এবং উপজেলা পরিষদেরও সম্মুখে অবস্থিত। এটি উপজেলার ৪নং মুরাদপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড। একই ওয়ার্ডে পেশকার পাড়াও রয়েছে। এ দুটি পাড়া পাশাপাশি অবস্থিত এবং মডেল গ্রাম হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ লোকজন কৃষিজীবি ও ব্যবসায়ী। সাম্প্রতিক এ পাড়ার দুই কীর্তি সন্তান জর্জ হিসেবে নিয়োগ পান। তাঁদের স্বামীরাও জর্জ। তাই সকলের কাছে জর্জ পাড়া হিসেবে অধিক পরিচিত লাভ করে দোয়াজি পাড়া। ইদানিং গুলিয়াখালি বীচ সড়ক হিসেবেও পরিচিতি পায়।
৯/৯/২৫ইং দুপুর আড়াইটা। সঙ্গত কারণে স্কুল ঘেঁষে যেতেই চোখে পড়লো স্কুল মাঠে কয়েকটি স্টল ও একটি স্টেজ। সিদ্ধান্ত নিলাম যেতে একটু উঁকি দিয়ে দেখে গেলে মন্দ হয় না। হাজারো হলেও আমাদের গ্রাম। এ গ্রামে কি হচ্ছে না হচ্ছে খবরাখবর রাখা উচিত। আর যে ইচ্ছে সে-ই কাজ। এমনিতে আমাদের স্কুলে-এ ধরনের আয়োজন কখনো চোখে পড়েনি। সঙ্গে মাঠে গিয়ে এক এক করে গুণতে লাগলাম, ৭টি স্টল ও একটি স্টেজ । তবে তেমন একটা লোকজন ছিল না। সম্ভবত দুপুরের সময় হওয়াতে গ্রামের লোকজন খেতে গেছেন। তবে দুই-একজন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রকে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে দেখলাম। প্রথম স্টলটিতে কিছু গৃহস্থালি জিনিসপত্র সাঁটিয়ে রেখেছেন। তার মধ্যে হাতে সেলাই করা নকশী কাঁথা, গায়ের চাদর ও নারীদের হাতের সেলাই করা ব্লাউজ। দ্বিতীয় স্টলের একটি কোটাতে রয়েছে কিছু শিমের বিচি ও অপর কোটায় শুকনো চিঁড়ে। এভাবে অন্যান্য স্টলেও গ্রামীণ জিনিস-পত্র সাঁটানো। কয়েকটি স্টলের সামনে গ্রামের কচু বন, লাল আলুর মাটির আঁটি , একটি লাউয়ে মাচাং, কাঁচা লঙ্কার গাছ ও একটি গ্রামীণ পুকুর-ডোবার নমুনা রয়েছে। সঙ্গে ডিমের খোসারও একটি ঝুড়ি দেখা গেল। উদ্যোক্তাদের একজন জানালেন, ডিমের খোসা, ফলমূলের খোসা ও সব্জির খোসা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা যায়। অপর এক আয়োজক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আনন্দ ও পিস এর কৃষি, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু হানিফ জানালেন, তাঁদের এ আয়োজন হলো অর্গানিক উৎপাদনে গ্রামীণ লোকজন ও কৃষকদের অধিক উৎসাহ দিতে। এটি তাদের রুরাল পর্যায়ের প্রজেক্ট। তিনি আরো বলেন, হাইব্রিড বা কৃত্রিম সার ও বিষাক্ত কীটনাশক মানব দেহে মারাত্মক রোগজীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে ক্যান্সারের মতো মরণঘাতীক রোগেরও ঝুঁকি বাড়ায়। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে-এ অর্গানিক কৃষি চাষাবাদ। জার্মান সরকারের অর্থায়নে এ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসব প্রদর্শনী আয়োজন করে। আয়োজনটি একদিনের জন্য হলেও তা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে আয়োজনে আয়োজকদের কিছু আপত্তি কথা আছে- তাঁরা নিজেরা-ই অর্গানিক ফুটের কথা বললেও নিজেদের দুপুরে খাওয়ার ম্যনুতে ছিল বিরিয়ানি ও কোঁকাকোলা মতো বিষাক্ত কোমল পানিয়! যা মানব দেহে মারাত্মক রোগজীবাণু ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। আয়োজকেরা-এ ক্ষেত্রে আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিল; এরপরও বলবো, এধরণের আয়োজনে গ্রামীণ জীবনে নিন্ম আয়ের লোকজনকে স্বয়ংপূর্ণতা পায়। তারা এটাকে প্রকৃতগত চাষাবাদ ও নিজ-নিজ আঙ্গিনায় শাক-সব্জী উৎপাদনে উৎসাহ সৃষ্টি করে এবং নিজেদের লাজুকতা বা জড়তা ও ভুলবোঝাবুঝি অবসানে সহায়ক করে তুলে।
গ্রামে গ্রামে ইদানীং চুরিচামারি বেড়েই চলেছে। আমাদের আদর্শ বা মডেল গ্রামও-এ চুরিচামারি হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। গত সাপ্তাহের ব্যবধানে গ্রামে নিরীহ খেটে খাওয়া লোকজনের গৃহস্থালি জিনিসপত্র চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটে। পাড়ার এমন কোনো ঘর নেই রাতে চোরের দল হানা দেয়নি। লোকজন এ সকল চোরের দলের উৎপাতে ভীতকর অবস্থায় আছে। পাড়ার মৃত রৌশন আলী সারাংয়ের ছেলে শাহজাহানে সিঁড়ি তলের পানির মোটর, কৃষক জয়নাল আবেদীনের ছেলে শাহেদের অটোরিকশার (সিএনজি) বেটারী ও যন্ত্রাংশ, রাজমিস্তিরি করিম উল্যাহ মুরগির আরাইলঘর থেকে দুই দফা হাঁস-মুরগী এবং মোবাইল-ফোন, ফার্নিচার ব্যবসায়ী ইসমাইলের দুই জোড়া হাঁস, হাসেমের বৈদ্যুতিক সার্ভিস তার, সাবেক সোনালী ব্যাংকের স্টাফ কাসেমের মুরগী ফার্মের বৈদ্যুতিক তার, স্যুইজ, হোল্ডার, বাল্ব, আর্টিসম্যান বোরহানের নতুন বিল্ডিংয়ের ওয়ারিং করতে আনা বৈদ্যুতিক তার এবং তার পরপর দুটি সাইকেল, প্রবাসী নুরুউদ্দিনের স্ত্রীর মোবাইল চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটে। আরো মাস দুইয়েক আগেও পাড়ার আব্দুল মোতালেব প্রকাশ জামাই মতুর মেজ ছেলে সালামের রিক্সা ভেন, রং মিস্তিরি শাহাদাতের একটি রিক্সা ভেন ও গ্রামের স্কুলের বৈদ্যুতিক পাখা ও টিউবওয়েল চুরির দুর্দান্ত ঘটনা ঘটে। গ্রামের একাধিকজন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এ চুরি হওয়ার ঘটনায় তারাও আতঙ্কের মধ্যে আছে। তারা আরো বলেন, অতীতে এধরণের গণহারে চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। মনে করা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে এ চুরি সঙ্ঘটিত হচ্ছে। তারা এ শঙ্কার থেকে পরিত্রাণ পেতে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা চায়।
লেখক: কবি, গবেষক ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/মিঞা জামশেদ উদ্দীন/এমই