পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধানে
প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১১ | অনলাইন সংস্করণ
ড. মাহরুফ চৌধুরী:

রাষ্ট্রকে পরিবার হিসেবে দেখার চিন্তা মানবিক রাষ্ট্র গঠনের এক আকর্ষণীয় রূপক। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘দ্যা রিপাবলিক’-এ আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তায় যেমন ন্যায়, দায়িত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক ও যত্নশীল পরিবার হিসেবে কল্পনা করাও এক গভীর রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রতিভাস বহন করে। তবে এই রূপক বাস্তবে প্রয়োগ করা হলে তা দুই বিপরীত পথে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে সহযোগিতা ও কল্যাণভিত্তিক পরিবারতত্ত্ব, অন্যদিকে ক্ষমতা ও বৈষম্যকেন্দ্রিক পরিবারতন্ত্র। রাষ্ট্র পরিচালনার এই দুই ধারণা আজ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গভীর তাৎপর্য বহন করে। একদিকে পরিবারতত্ত্ব নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি অংশীদারিত্বমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা করতে পারে। অন্যদিকে পরিবারতন্ত্র রাজনীতিকে পেশাগত দক্ষতা ও গণতান্ত্রিক মেধার বদলে বংশানুক্রমিক নিয়ন্ত্রণের পথে নিয়ে যায়, যা এক ধরনের ক্ষমতার বংশগত প্রবৃদ্ধি ও ব্যক্তিস্বার্থ-নির্ভর রাষ্ট্র গঠনের ঝুঁকি তৈরি করে। ‘পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র’ বিষয়ে পূর্বের তিনটি পর্বে আমরা বিশ্লেষণ করেছি, কীভাবে পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে, নেতৃত্ব বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যকে চিরস্থায়ী করে তোলে। এবার আমাদের আলোচনার লক্ষ্য পরিবারতত্ত্বকে কীভাবে বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তা হিসেবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব- এই দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণা নিয়ে পূর্ববর্তী লেখাগুলোতে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। আলোচনার প্রবাহ রক্ষার্থে এখানে সংক্ষেপে তা পুনঃউল্লেখ করা প্রয়োজন। পরিবারতন্ত্র হলো রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার উত্তরাধিকারভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা, যেখানে নেতৃত্ব একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই ব্যবস্থায় নেতৃত্বের মানদণ্ড হয়ে ওঠে বংশপরম্পরা, যোগ্যতা বা জনআস্থা নয়। এর ফলে গণতন্ত্রের মূলভিত্তি পরমতসহিষ্ণুতা এবং গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি তথা জনঅংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও নেতৃত্বে পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা বজায় থাকলেও তা হয়ে ওঠে প্রহসনমূলক, নেতৃত্ব পরিবর্তনের পথ থাকে রুদ্ধ এবং ক্ষমতার চক্র একটি সংকুচিত গোষ্ঠীর মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে। এই ধরনের কাঠামো ‘গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র’ (ডেমক্র্যাটিক মোনার্কি) বা ‘নব্য-স্বৈরতন্ত্র’ (নিও-অথোরিটারিয়ানিজম) নামে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে পরিচিত। অন্যদিকে পরিবারতত্ত্ব রাষ্ট্রকে একটি বৃহত্তর ন্যায়কেন্দ্রিক পরিবার হিসেবে কল্পনা করে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগের অধিকারী। এই ধারণার মূল ভিত্তি হলো সামাজিক ন্যায়বিচারের বোধ, দায়িত্ববোধ, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। পরিবারতত্ত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং যোগ্যতা তথা মানুষের আস্থা, নৈতিকতা, মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। এ ধারা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং ক্ষমতাকে জনগণের কল্যাণে ব্যবহারের নৈতিক দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ রাখে। এইভাবেই পরিবারতত্ত্ব একটি মানবিক, ন্যায়কেন্দ্রিক ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রচিন্তার পথকে উন্মুক্ত করে।
পরিবারতত্ত্বকে একটি কার্যকর রাষ্ট্রনৈতিক নীতিতে রূপ দিতে হলে তা কেবল আদর্শিক কল্পনা হিসেবে নয়, বরং বাস্তব রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচনা ও প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবহে পরিবারতন্ত্র থেকে উত্তরণের পথ কণ্টকাকীর্ণ। কারণ এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রচলিত বিন্যাসে ক্ষমতার গভীরে প্রোথিত এক প্রাতিষ্ঠানিক অপসংস্কৃতি। এই প্রেক্ষাপটে, পরিবারতত্ত্বকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে চারটি মূল কৌশল অনুসরণ করা জরুরি। এগুলো একাধারে নীতিগত এবং বাস্তবধর্মী, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে সহায়ক হতে পারে। নিচে এই কৌশলগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
নৈতিক নেতৃত্বের উত্থান ঘটানো। পরিবারতন্ত্রের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে নেতৃত্ব বাছাইয়ে নৈতিকতা ও যোগ্যতার বদলে বংশানুক্রমিক পরিচয়কে প্রধান বিবেচ্য করে তোলা। এর ফলে রাজনীতি হয়ে পড়ে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার, জনসেবার বদলে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রতিযোগিতা। পরিবারতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তায় এর বিপরীতে প্রয়োজন নেতৃত্বের নৈতিক ও পেশাগত পুনর্নির্মাণ। নেতৃত্ব নির্বাচন ও মূল্যায়নে বংশগত উত্তরাধিকার নয়, বরং ব্যক্তিগত যোগ্যতা তথা জনআস্থা, ব্যক্তিগত নীতি- নৈতিকতা, মেধা ও দক্ষতা প্রাধান্য পেতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকে একটি সম্মানজনক ও জনমুখী দায়-দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়া হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নেতৃত্ব আসবে সেবার মানসিকতা, ত্যাগের মনোভাব এবং জনকল্যাণে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। এমন নৈতিক নেতৃত্বের অনুকরণশীল দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আমরা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯–১৯৪৮), নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩) কিংবা সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫) মধ্যে দেখতে পাই, যাঁরা ব্যক্তিগত ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য রাজনীতিকে একটি আত্মত্যাগের ব্রতে পরিণত করেছিলেন। সুতরাং পরিবারতন্ত্র ভেঙে নৈতিক নেতৃত্বের উত্থান ঘটাতে হলে দরকার শিক্ষা, জনসচেতনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সমন্বিত প্রয়াস।
গণতান্ত্রিক সংস্কার ও নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি করা। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি নয়, বরং গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মূল ভিত্তি। কিন্তু যখন দলের অভ্যন্তরেই গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব থাকে, তখন সেসব দল রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে স্বভাবতই কর্তৃত্ববাদী ও পরিবারতান্ত্রিক রূপ ধারণ করে। তাই পরিবারতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তা বাস্তবায়নের জন্য প্রথম শর্ত হল দলের অভ্যন্তরে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এখানে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থিতা মনোনয়নে শুধু শীর্ষ নেতার পছন্দ নয়, বরং দলীয় কর্মীদের মতামত, মাঠপর্যায়ের কার্যকর অবদান এবং জনআস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মাঝে এমন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তরুণ ও বিকল্পধারার নেতৃত্ব যাতে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, তার জন্য প্রয়োজন প্রতিযোগিতামূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এই সংস্কার প্রক্রিয়া কোনো রাজনৈতিক সৌজন্য নয় বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া টিকে থাকার পূর্বশর্ত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হতে সময় নেয় না। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর সংগঠন কাঠামোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা শুধু নৈতিক দায় নয়, জাতীয় স্বার্থেও অপরিহার্য।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও গণমুখী করা। পরিবারতন্ত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের অন্যতম উপাদান। এর বিপরীতে, পরিবারতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে গণমুখী কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণ কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয়, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয় এবং পরিবারতন্ত্রের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে জনগণ সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে এবং তৃণমূল পর্যায়ে তাদের প্রয়োজন, স্বার্থ ও প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়। জনপ্রতিনিধিরা তখন জনগণের কাছেই দায়বদ্ধ থাকেন, কেন্দ্রের প্রতি নয়। ভারত, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে স্থানীয় সরকারের বিকাশ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এনেছে। বাংলাদেশেও স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করতে হলে প্রয়োজন অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন এবং দলীয় হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা। শুধু নির্বাচনের আয়োজন নয়, বরং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাজেট বরাদ্দ ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাস্তব ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। এই প্রক্রিয়া পরিবারতন্ত্রের কেন্দ্রিকরণকে দুর্বল করে জনসম্পৃক্ত, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের পথ প্রশস্ত করবে যা পরিবারতত্ত্বের মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ব্যাপক জনশিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কর্মকান্ড পরিচালনা করা। পরিবারতন্ত্রের প্রভাব দূর করতে হলে কেবল রাজনৈতিক কাঠামো নয়, নাগরিক মানসও বদলাতে হবে। আর এই মানসগঠনের অন্যতম প্রধান উপায় হল জনশিক্ষার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের শুরু থেকেই দায়িত্ববোধ, মানবিকতা, অংশগ্রহণমূলক আচরণ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখাতে হবে। নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবারতত্ত্বের ভিত্তি সুদৃঢ় করা সম্ভব। তবে শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে ন্যায়, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাশীল আচরণের চর্চা, শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত উদ্যোগে গণতান্ত্রিক জীবনচর্চার অনুশীলন জরুরি। সাথে সাথে জনশিক্ষার নানা আয়োজনের মাধ্যমে আলোকিত নাগরিক গড়ার জন্য একে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে।
জনশিক্ষার প্রক্রিয়ায় এই সচেতনতা গঠনে কার্যকর পাটাতন হিসেবে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কিন্তু তা তখনই কার্যকর হবে, যখন এই মাধ্যমগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবে। শুধু উত্তেজক বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) নয়, বরং গঠনমূলক আলোচনা-পর্যালোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক বিষয়বস্তু উপস্থাপনে জনশিক্ষার উপানুষ্ঠানিক ধারাকে নাগরিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি এবং আচরণিক পরিবর্তনে ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন নাগরিক পাটাতন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় নেতৃত্বকে এসব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে পারলে অচিরেই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে শুরু করবে। সামাজিক ও নাগরিক সচেতনতা ছাড়া কাঠামোগত সংস্কার অনেক সময়ই লোকদেখানো হয়ে পড়ে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষা ও জনসচেতনতা পরিবারতত্ত্বকে কার্যকর রাষ্ট্রচিন্তায় পরিণত করার জন্য মৌলিক ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।
বাংলাদেশের স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে পরিবারতন্ত্র শুধু রাজনৈতিক অভ্যাস নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোয় গভীরভাবে প্রোথিত একটি সংস্কৃতি। ফলে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে পরিবারতত্ত্বের ধারণাকে যদি কেবল রোমান্টিক আদর্শ কল্পনা হিসেবে তুলে ধরা হয়, তা ফলপ্রসূ হবে না। এর পরিবর্তে প্রয়োজন, পরিবারতত্ত্বকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে এক্য’ প্রতিষ্ঠায় একটি বাস্তববাদী, নৈতিক ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রদর্শনে রূপ দেওয়া যাকে বলা যায় নৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্ব। এই তত্ত্বে রাষ্ট্র হবে সবার, সেবার, সহমর্মিতার ও মানবিক দায়িত্ববোধের প্রতিষ্ঠান, কেবল ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠি বা দল বিশেষের শাসন বা ক্ষমতার আধার নয়। এখানে নেতৃত্ব মানে হবে জনগণের আস্থা অর্জনকারী, দক্ষ এবং নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ অভিভাবকত্ব; যারা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করবেন।
পরিবারতত্ত্বের এই রূপকল্পে নাগরিকরা ‘প্রজা’ নন, বরং রাষ্ট্রনামক পরিবারের সক্রিয় অংশীদার। পরিবারের সদস্য হিসেবে তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার ও সুযোগ পাবেন। ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী রুশো (১৭১২-১৭৭৮) মতে যেমন সামাজিক চুক্তিতে নাগরিকের সম্মতির ওপর রাষ্ট্রের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি এই ‘নৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্ব’ নাগরিক ও রাষ্ট্রের মাঝে সম্পর্ককে নির্মাণ করবে আস্থা ও দায়িত্বের পারস্পরিক বন্ধনে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পুণ:বিন্যাসে পরিবারতত্ত্বের এই বাস্তবায় কল্পনা তাই একদিকে পরিবারতন্ত্রের সর্বগ্রাসী নেতিবাচক প্রভাবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্নকে এগিয়ে নেবে। অন্যদিকে একটি আমাদের জন্য মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের দর্শন হয়ে উঠতে পারে যেখানে ক্ষমতা নয়, বরং সেবা, নৈতিকতা ও অংশগ্রহণ রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হবে।
পরিবারতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে এমন এক সংকটে ফেলে দিয়েছে, যার ফলে নেতৃত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়েছে এবং সমাজে বৈষম্য ও অনিরাপত্তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের একচেটিয়া দখল, দলীয় ক্ষমতার গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ব্যবহার এবং উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নেতৃত্বের অধিকার নির্ধারণ দেশের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্রকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তা হিসেবে পরিবারতত্ত্বের ভিত্তিতে একটি মানবিক, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রগঠনের অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি। এই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে অন্তর্ভুক্তি, যেখানে সব শ্রেণি, পেশা ও জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রতিফলিত হবে; থাকবে ন্যায়বিচার যা কেবল আইনের ভাষ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং নাগরিক মর্যাদার বাস্তব রক্ষাকবচ হবে; এবং থাকবে জবাবদিহিতা যেখানে নেতৃত্বের প্রতিটি কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। পরিবারতন্ত্রের অবসান শুধু রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয় নয়, এটি মূলত নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত অগ্রগতি এবং জাগরণের অংশ। দেশের নাগরিকদের এই জাগরণ ছাড়া কোনো মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন সম্ভব নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ স্বভাবতই পক্ষপাতিত্ব দোষে আক্রান্ত এবং সে কারণে বাংলায় ‘রক্তের টান’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। তাই পরিবারতন্ত্রের গড়পড়তা আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘ, জটিল ও বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডলে সর্বত্রই পরিবারতন্ত্রের প্রভাব লক্ষনীয়। আর সে কারণে কেবল রাজনৈতিক সংস্কার নয়, বরং জাতীয় কল্যাণে আমাদের নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। আমাদের বিশ্বাস, চেতনা ও অভ্যস্ততার প্রাত্যহিক চর্চায় পরিবারতন্ত্রের জটিল ও বহুস্তরীয় প্রভাব বলয়ের এই দেয়াল অনতিক্রম্য নয়। যদি আমরা নাগরিক সচেতনতার প্রসার, রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রায়ন এবং নেতৃত্বের নৈতিক উৎকর্ষ নিশ্চিত করতে পারি, তবে একটি সমতাভিত্তিক, মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণ আর অলীক কল্পনা থাকবে না।
আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরে পরিবারতত্ত্ব কেবল একটি ধারণাতাত্ত্বিক বিকল্প নয়। বরং এটি হতে পারে এক সক্রিয়, নৈতিক এবং বাস্তববাদী রাষ্ট্রনৈতিক কৌশল যার মধ্য দিয়ে নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা এবং মানবিক মূল্যবোধের সম্মিলন ঘটানো সম্ভব। রাষ্ট্রকে যদি সত্যিকার অর্থে একটি দায়িত্বশীল পরিবার হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তবে সেখানে থাকবে না বংশানুক্রমিক শাসনের একচেটিয়া আধিপত্য, বরং থাকবে ন্যায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতার ভাগবাটোয়া তথা বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে কর্তৃত্ব ও দায়দায়িত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা। রাষ্ট্রকে পরিবার হিসেবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গিই হতে পারে আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাগরণের ভিত্তি যা আমাদেরকে মুক্ত করবে পুরনো পরিবারতন্ত্রের নিস্পেষণের নিগড় থেকে এবং অতি শীঘ্রই পৌঁছে দেবে একটি মানবিক কল্যাণমুখি রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বারপ্রান্তে।
লেখক : ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।
আমার বার্তা/জেএইচ