ফিতরা ইসলামের মহান দান এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর ব্যবস্থা
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ১৯:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ
বিল্লাল বিন কাশেম:

রমজানের সিয়াম সাধনার শেষে মুসলিম উম্মাহর জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরা)। এটি এক ধরনের বাধ্যতামূলক দান, যা রমজানের শেষ দিকে আদায় করা হয় এবং ঈদের আগেই গরিব-দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ফিতরার মূল লক্ষ্য হলো দরিদ্র মানুষদের ঈদের আনন্দে শরিক করা এবং মুসলিম সমাজে সাম্যের বোধ তৈরি করা।
বাংলাদেশে চলতি বছর (১৪৪৬ হিজরি/২০২৫ খ্রিস্টাব্দ) ফিতরার হার সর্বনিম্ন ১১০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২,৮০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২,৯৭০ টাকা ছিল। ফিতরার এই পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় গম, আটা, যব, খেজুর, কিশমিশ ও পনিরের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, সামর্থ্য অনুযায়ী এই পণ্যগুলোর নির্দিষ্ট পরিমাণ বা এর সমমূল্যের অর্থ দিয়ে ফিতরা প্রদান করা যায়।
ফিতরার গুরুত্ব ও ইসলামের বিধান
ফিতরার বিধান সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়।
১. কুরআনে ফিতরার নির্দেশনা:
আল্লাহ তাআলা বলেন, "তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো। তোমরা নিজেদের জন্য যা অগ্রিম পাঠিয়ে দাও, তা আল্লাহর কাছে পাবে।" (সূরা আল-বাকারাহ: ১১০)
যদিও এই আয়াত সরাসরি ফিতরার কথা উল্লেখ করে না, তবে ইসলামিক ব্যাখ্যাগুলোতে যাকাত ও ফিতরার সম্পর্কিত নির্দেশনাগুলো একত্রে আলোচিত হয়েছে।
২. হাদিসে ফিতরার নির্দেশনা:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব, তা এক সা’ (প্রায় ২.৫ কেজি) খেজুর বা যব। এটি দাস-মুক্ত, পুরুষ-নারী, ছোট-বড় সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য।’" (বুখারি: ১৫০৩, মুসলিম: ৯৮৪)
অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে: "আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সিয়ামের পবিত্রতা এবং গরিব-মিসকিনদের জন্য খাদ্যের সংস্থান হিসেবে সাদাকাতুল ফিতরকে ফরজ করেছেন।’" (আবু দাউদ: ১৬০৯)
এই হাদিসগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, ফিতরা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এটি রোজার পরিপূর্ণতা অর্জনের মাধ্যম।
ফিতরার পরিমাণ ও এর হিসাব
ফিতরার নির্ধারিত পরিমাণ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মুসলিমকে ১ সা’ খাদ্যশস্য বা তার মূল্য প্রদান করতে হবে। এক সা’ সাধারণত ২.৫-৩ কেজির সমতুল্য। বাংলাদেশে ২০২৫ সালে ফিতরার হার নিম্নলিখিত উপায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে:
খাদ্যপণ্যপরিমাণ (প্রায় ২.৫-৩ কেজি)বাজারমূল্য অনুযায়ী সর্বনিম্ন-সর্বোচ্চ ফিতরা (টাকা)গম/আটা৩ কেজি১১০ টাকাযব৩ কেজি৩৩০ টাকাখেজুর৩ কেজি১,৬৫০ টাকাকিশমিশ৩ কেজি২,৮০৫ টাকাপনির৩ কেজি২,৮০৫ টাকা
ফিতরা প্রদানের বিধান ও উপযুক্ত ব্যক্তিরা
ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান রয়েছে:
১. কে ফিতরা প্রদান করবেন?
প্রত্যেক মুসলিম, যিনি নিজের ও পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ রাখেন, তাকে ফিতরা দিতে হবে।
পিতার দায়িত্ব হলো তার ছোট সন্তানদের ফিতরা প্রদান করা।
পরিবারের প্রধান ব্যক্তি যদি সক্ষম হন, তবে পরিবারের অসামর্থ্য ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেও তিনি ফিতরা আদায় করতে পারেন।
২. ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে?
ইসলামিক বিধান অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা ফিতরার হকদার:
দরিদ্র ও অভাবী মানুষ
মিসকিন (অত্যন্ত দুঃস্থ)
যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তি
নিঃস্ব ভ্রমণকারী
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, যিনি নিজের ঋণ পরিশোধে অক্ষম
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "ফিতরা হলো দরিদ্রদের জন্য খাদ্যের সংস্থান।" (সুনানে আবু দাউদ) ফিতরা আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং সত্যিকারের অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করাই উত্তম।
ফিতরা আদায়ের সময় ও পদ্ধতি
ফিতরা আদায়ের জন্য সময়সীমা নির্ধারিত রয়েছে:
ফিতরা আদায়ের উত্তম সময় হলো ঈদের সালাতের পূর্বে।
তবে, কেউ যদি আগে দিতে চান, তাহলে রমজান মাসের শেষ কয়েক দিনে দেওয়া যেতে পারে।
যদি কেউ ঈদের নামাজের পর ফিতরা প্রদান করেন, তবে তা সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে, ফিতরা হিসেবে নয়।
সমাজে ফিতরার ইতিবাচক প্রভাব
ফিতরার মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:
দরিদ্র ও অসহায় মানুষ ঈদের আনন্দ উপভোগের সুযোগ পায়।
সাম্যের বোধ বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা হয়।
এটি ধনী-গরিবের মধ্যকার বিভাজন কমিয়ে আনে এবং মানুষের মধ্যে সহমর্মিতার সৃষ্টি করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিতরার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ বেড়েছে। বাংলাদেশেও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ফিতরা তাদের জন্য একটি বড় সহায়তা হতে পারে।
ফিতরা ও আমাদের করণীয় :
ফিতরা যথাসময়ে প্রদান করা। প্রকৃত গরিব ও অসহায়দের মাঝে বিতরণ করা।
ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে ফিতরা দেওয়া, যাতে এটি প্রকৃত অর্থে কল্যাণ বয়ে আনে। ফিতরা শুধু একটি দান নয়, বরং এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যা রোজার পরিপূর্ণতা আনে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। এটি দরিদ্রদের সহায়তা করে এবং ঈদের আনন্দ সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। তাই, আমাদের উচিত যথাযথভাবে ফিতরা আদায় করা এবং এর মাধ্যমে ইসলামের মানবিকতা ও সাম্যের বার্তা বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে ফিতরা আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: গণসংযোগ কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা।
আমার বার্তা/এমই