জেনজে প্রজন্মের রাজনীতির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চ্যালেঞ্জ
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:৩৩ | অনলাইন সংস্করণ
বিল্লাল বিন কাশেম:
বর্তমান বিশ্বে, বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, জেনজে (Gen Z) প্রজন্মের রাজনীতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনায় এসেছে। এই প্রজন্মের সদস্যরা ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তারা ডিজিটাল যুগের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই প্রজন্মের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত তথ্য প্রবাহ, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং আদর্শের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রজন্মের রাজনীতির শিকড় কতটা দৃঢ় হবে, তা নির্ভর করবে তাদের নিজেদের সংগ্রাম, চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান খোঁজার উপর।
১. ডিজিটাল যুগের রাজনীতি
জেনজে প্রজন্মের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রযুক্তির সাথে গভীরভাবে যুক্ত। সামাজিক মাধ্যমের যুগে বেড়ে উঠা এই প্রজন্ম, রাজনৈতিক তথ্য আদান-প্রদান, মতামত প্রকাশ এবং সংগঠন গঠনে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি সামাজিক মিডিয়া তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ হয়ে উঠেছে। তারা তাদের চিন্তাভাবনা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ‘Black Lives Matter’ বা ‘Me Too’ আন্দোলনগুলি বিশ্বের নানা প্রান্তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যা জেনজে প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফল।
তবে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের রাজনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। মিথ্যা তথ্য বা 'ফেক নিউজ' ছড়ানো, সাইবার বুলিং এবং গণমাধ্যমের ভুল প্রপাগান্ডা এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এ কারণে, তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও পরিপক্বতা আরও গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।
২. পরিবেশগত সচেতনতা
পরিবেশগত সমস্যা আজকের দিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্লাস্টিক দূষণ, বনভূমি নিধন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে জেনজে প্রজন্ম অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এই প্রজন্মের সদস্যরা বিভিন্ন পরিবেশগত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে, যেমন গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে গঠিত 'Fridays for Future' আন্দোলন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেড়ে ওঠা যুব সমাজও এই সমস্যাগুলো নিয়ে আন্দোলন করছে। ভবিষ্যতে, পরিবেশগত পরিবর্তন এবং এর সাথে সম্পর্কিত রাজনীতি জেনজে প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে।
৩. বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়
জেনজে প্রজন্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সাম্যের প্রতি আকর্ষণ। লিঙ্গ বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, এবং সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই মুক্তমনা। তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, সাম্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য প্রায়ই রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়।
বিশ্বব্যাপী জেনজে প্রজন্মের মধ্যে সমকামী অধিকার, নারী অধিকার এবং মানুষের মানবাধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে চায়।
৪. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও চাকরি সংকট
বিশ্বের বহু দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটা ধীর গতিতে চলছে। বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রজন্মের সদস্যরা উচ্চ শিক্ষা লাভের পরও কর্মসংস্থানে সঠিক সুযোগ পাচ্ছে না, যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে, আগামী দিনে এই প্রজন্মের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আরও শক্তিশালী হতে পারে।
তবে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং ডিজিটাল শিল্পের বিকাশ, স্টার্টআপ সংস্কৃতি ইত্যাদি জেনজে প্রজন্মকে নতুন চাকরি এবং উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই প্রজন্ম তাদের ক্ষমতা ও উদ্ভাবনশীলতার মাধ্যমে এক নতুন অর্থনৈতিক যুগ সৃষ্টি করতে পারে।
৫. রাজনীতি এবং ভোটদান
জেনজে প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রবণতা কম বলে মনে হলেও, একাধিক দেশে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে। তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যোগ দেয়, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তাদের আস্থা খুব বেশি নয়। বাংলাদেশেও এই প্রজন্মের মধ্যে ভোটদান ও রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তারা রাজনীতির প্রতি সাদৃশ্যপূর্ণ বা আস্থাশীল না হলেও, দেশের ভবিষ্যতের জন্য তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বা স্কুলে রাজনীতি বিষয়ে আলোচনার অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনীতির প্রতি এই প্রজন্মের অনীহা সৃষ্টি করেছে। তবুও, ভবিষ্যতে তরুণ ভোটার হিসেবে তাদের ভূমিকা বহুমুখী হয়ে উঠতে পারে।
৬. ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
জেনজে প্রজন্মের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ভর করছে তাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, পরিবেশগত সচেতনতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের ওপর। তারা যে রাজনৈতিক কাঠামো এবং আদর্শ তৈরি করবে, তা তাদের রাজনৈতিক সংহতি, সচেতনতা এবং যুক্তির ওপর ভিত্তি করে হতে হবে। এই প্রজন্মের পক্ষে রাজনীতির ক্ষেত্রটি একেবারে নতুন, তবে তাদের সৃজনশীলতা, নতুনত্ব এবং সমাধানের প্রতি আগ্রহ তাদেরকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
নতুন প্রজন্মের চ্যালেঞ্জগুলি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্যও অনেকটা অভিন্ন। প্রযুক্তি, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল জাতীয় স্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জেনজে প্রজন্মের রাজনীতি, একটি বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটে, ভবিষ্যতের বিশ্ব রাজনীতির এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। তাদের রাজনৈতিক আস্থাশীলতা, একযোগিতার চিন্তা, পরিবেশের প্রতি যত্ন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা আধুনিক বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, এই প্রজন্মকে যথাযথ শিক্ষা, সমর্থন এবং সুযোগ প্রদান করা একান্ত জরুরি, যাতে তারা নিজেদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর উপস্থাপন করতে পারে এবং আগামী দিনের একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ এবং সমন্বিত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : কবি, গল্পকার ও কলামিস্ট।
আমার বার্তা/বিল্লাল বিন কাশেম/এমই