মাছে ভাতে বাঙ্গালী
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:
মাছ ভাত বাঙ্গালীর প্রধান খাবার। এতেই বাঙ্গালী খাবারে পরিপূর্ণ র্তপ্তি পায়। মাছে-ভাতে বাঙাালি এই পরিচয়ে জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তার প্রতীক। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ,কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, মৎস্য খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার,জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান,রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে আরো সম্পৃক্ত ও সচেতন করার প্রয়াসে মৎস্য অধিদপ্তর অবিরাম কাজ করছে।
বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি,জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, মৎস্য অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন,ইলিশ সম্পদের সংরক্ষণ, সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিকাশে সামুদ্রিক মাছের মজুদ নিরুপণ ও স্থায়িত্বশীল আহরণ, মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের ভ্যালুচেইন উন্নয়ন,রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৯ দশমিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০ দশমিক ৬২ লাখ মেট্রিক টন) চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে মৎস্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণ ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে।দেশের মোট জিডিপি’র ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২২ দমমিক ২৬ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ২ কোটি তথা প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ আ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২৪’শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরিণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ২য়,বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম এবং ইলিশ উৎপাদনে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ যা মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১১ শতাংশ যোগান দেয়।ইলিশ সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জাটকা রক্ষায় নভেম্বর হতে জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা বন্ধ রাখা,ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা,অভয়াশ্রম স্থাপন,জনসচেতনতা সৃষ্টি,মোবাইল কোর্ট ও অভিযান পরিচালনা। এই সময়ে জেলেদের ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান এবং বিকল্প কর্মসং¯া’নের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে উৎপাদন ছিল দুই লক্ষ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ লক্ষ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
কূটনৈতিক দূরদর্শিতায় ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক জলসীমায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।ফলে সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়েছে।সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সর্বোত্তম আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘আরভি মীন সন্ধানী’নামক গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ৪৪টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করা হয়েছে।এছাড়াও গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন,২০২০’,‘সামুদ্রিক মৎস্য আহরন নীতিমালা,২০২২’এবং ‘সামুদ্রিক মৎস্য নীতিমালা,২০২৩’প্রণয়ন করা হয়েছে।প্রতিবছর ২০ মে হতে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন সমুদ্র ও উপক’লীয় জলায়তনে সকল নৌযান দিয়ে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জীববৈচিত্র রক্ষা,টেকসই মৎস্য আহরণ ও সুনীল অর্থনীতি সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে গত ২৮ মে .দেশের ৫ম সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসিবে ‘নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা’ঘোষণা করেছে সরকার।
সরকার প্রকৃত জেলেদের সনাক্ত করে তাদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান অব্যাহত রয়েছে।জেলে নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে।এযাবত নিবন্ধিত প্রায় ১৮.১০ লক্ষ জেলের মধ্যে ১৫.৮০ লক্ষ জেলেকে পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে।জাটকা সংরক্ষণে ৪ মাস পরিবার প্রতি মাসিক ৪০ কেজি এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২দিনের জন্য পরিবার প্রতি ২৫ কেজি হারে চাল প্রদান করা হয়।২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে ৯লক্ষ ১৫ হাজার ৭৫৬টি জেলে পরিবারকে মোট ৭১ হাজার ৬ শথ ১১ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।এছাড়াও প্রতিবছর ৬৫ দিন সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালে উপক’লীয় জেলার নিবন্ধিত জেলেদের মাসিক ৪০ কেজি হারে ভিজিএফ(চাল) বিতরণ করা হয়।
সাসটেইনেবল কোস্টাল আ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় মাছের ভ্যালু চেইন উন্নয়ন,আহরণোত্তর অপচয় হ্রাস ও রোগমুক্ত চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিত করে রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ০৩টি ফিশ হেলথ ডায়াহনস্টিক ল্যাব, ০৪টি ফিশ কোয়ারেন্টাইন ল্যাব ও ০৩টি পিসিআর ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।রোগমুক্ত ও মানসম্পন্ন এসপিএফ চিংড়ি পোনা সরবরাহ নিশ্চিত করতে ৩টি ব্রুড ম্যানেজমেন্ট সেন্টার,৯টি হ্যাচারি, ০৯টি নার্সারি ও ০১টি আর্টিমিয়া নপ্নি সেন্টারকে অনুদান প্রদান করা হয়েছে।চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম টেকসই করতে ৩০০টি চিংড়ি ক্লাস্টারের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও চিংড়ির আহরণোত্তর ক্ষতি হ্রাস ও গুণগত মান অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে ১৭টি পোস্ট হার্ভেষ্ট সার্ভিস সেন্টার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।কক্সবাজার জেলায় চকোরিয়া উপজেলায় সরকারি চিংড়ি এস্টেটে একটি স্মার্ট চিংড়ি সিটি স্থাপনের লক্ষ্যে মাস্টার প্লান প্রণয়ন কাজ চলমান রয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরিণ জলাশয়ে দেশীয় মাছ সংরক্ষণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয় নানামূখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে,প্রতিষ্ঠা করেছে ১০২ প্রজাতির দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক।উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে পোনা মাছ অবমুক্তি ও বিল নার্সারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতি সংরক্ষণ, অবাধ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৯৪টি অভয়াশ্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৫০টিরও অধিক দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে।বিশ্ববাজার আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৭৪০৮ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৪০৫.৭২ মিলিয়ন ইউএস ডলার ( অর্থাৎ প্রায় ৪৪৯৬.৩৮ কোটি টাকার সমমূল্যের) বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হয়েছে।আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।সে লক্ষ্যে গত ১৭-১৯ জুলাই“বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকুয়াকালচার ও সি-ফুড শো-২০২৪”আয়োজন করা হয়।
মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য গণমাধ্যম বিগত সময়ে বলিষ্ঠ ভ’মিকা পালন করেছে। মাছসহ অন্যান্য জলজসম্পদের নিরাপদ ও স্থায়িত্বশীল উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টি ও চাহিদা পূরণ,রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর কাঙ্খিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে সমৃদ্ব বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা জরুরী।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের সময়ও দ্যা ডেইলি বেষ্ট নিউজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই