পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা রুখতে হবে

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৩০ | অনলাইন সংস্করণ

  রায়হান আহমেদ তপাদার:

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ভারত সরকার এবং সেখানরকার হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমের বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডা অস্বাভাবিক মাত্রায় উপনীত হয়েছে। গত সাড়ে তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ করে দেয়ার যেসব অপতৎপরতা দেখা গেছে, তার সবগুলোর সাথেই শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় যোগসাজশ স্পষ্ট। শাহবাগে হিন্দু মহাজোটের সমাবেশ ও সচিবালয়ে আনসারদের ঘেরাও কর্মসূচি থেকে শুরু করে রিকশা-অটোচালকদের অবরোধ আন্দোলন এবং সর্বশেষ সনাতনী জাগরণ জোটের উস্কানি এবং চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের হাতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকা-সহ প্রতিটি উগ্রবাদী ঘটনার সাথে ইসকন এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের মদত ও অংশগ্রহণ দেখা গেছে। সরকারের প্রশাসন, গণমাধ্যম, শিক্ষাঙ্গন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে ঘাঁপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসররা পারস্পরিক হানাহানি ও বিভক্তির জাল বিছিয়ে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল এজেন্ডা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং এ লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত করা। অন্যদিকে ভারতীয় এজেন্ট ও তাবেদাররা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ন্যারেটিভের আলোকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিভাজন সৃষ্টি করে ভারতের আধিপত্যবাদী স্বার্থ টিকিয়ে রেখে অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের মৌরসি পাট্টা অব্যাহত রাখতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা যে কোনো মূল্যে ভারতীয় ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বির্নিমাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।গত পনের বছর ধরে হাজার হাজার মানুষের গুম-খুন, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি-পাচার, ছাত্র-জনতার উপর গুলির নির্দেশ দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হতাহত করার পরও পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কোনো আক্ষেপ বা অনুশোচনা নেই!

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার দিন থেকেই বাংলাদেশ বিরোধী হুঙ্কার ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের অপতৎপরতা উদ্বেগজনক হয়ে দেখা দিয়েছে। সারা দেশে একটি পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। গত কয়েক দিন যাবৎ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব ঘটনা ঘটেছে, এ ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। দেশে যেন স্বাধীনতার এক উৎসব শুরু হয়েছে। যে যে দিক দিয়ে পারছে তার মন মতো স্বাধীনতা কায়েম করার চেষ্টা করছে। মন যা চায় তাই করছে। এতে গণঅভ্যুত্থানে তৈরি হওয়া নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা মার খেতে বসেছে। গোটা দেশের পরতে পরতে বিরতিহীন স্বাধীনতার চর্চা যেন চলছে। এর মধ্যদিয়ে এ সরকারকে একদিনও শান্তিতে থাকতে না দেয়ার একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নমুনা স্পষ্ট। গোটা আবহটা মোটেই সুখকর নয়। প্রশাসনে লাগামছাড়া ভাব। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে সংঘাত-সংঘর্ষ ছড়াচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মাঝে অনৈক্য, সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কয়েকজন সরকারে আছেন। আবার রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত কয়েকজন। সরকারের সমালোচনার বিপরীতে সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ করার দাবি করছেন তাদের কেউ কেউ। যে তারুণ্য জাতির বুকের উপর থেকে ১৫ বছরের পাথর সরালো, আজ সেই তারুণ্যকে নানাভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের চালিকা শক্তি ছাত্রদেরকে দুর্বল করা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। বাম ও ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি অভ্যুত্থানে এবং পরবর্তী সময়ে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে উঠছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড গোটা দেশটাকে অস্থির করে রেখেছে।

অথচ ছাত্ররা অন্তর্বর্তী সরকারের মূল চালিকা শক্তি, একথা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর ক্ষমতাপ্রত্যাশী হয়ে ওঠা অনেকের ভেতরও টেনশন। কোত্থেকে কী হয়ে যাচ্ছে বুঝে উঠতে উঠতেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, ভাবুক ও চিন্তক গোষ্ঠী সভা, সেমিনার, ওয়েবিনার, ফেসবুক বা ইউটিউবে অস্তিত্বের জানান দিলেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তার ওপর অচেনা গোপন শক্তি তৎপর। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের এ অবস্থার মাঝে নানান চিন্তায় আগোয়ান সম্প্রদায়গত একাধিক গ্রুপ। তারা হিন্দু-মুসলিম দুদিকেই। পু-রীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে জাতীয় পতাকা অবমাননার মামলায়। তার তৎপরতা ভিন্নদিকে, যা কৌশলগত কারণে সামনে আনতে চায় না সরকার। বিএনপিও এ ব্যাপারে অতি কৌসলী। আওয়ামী লীগ রাখঢাক রাখেনি। তাকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ অনতিবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেছে। অদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর প্রতিক্রিয়া মারাত্মক ঝাঁঝালো। চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও ইসকন নেতা উল্লেখ করে নিন্দাই জানাননি তিনি, তাকে মুক্তি না দিলে সীমান্তে সনাতনীরা ধ্বজ নিয়ে অবরোধ করবে বলে হুমকিও দিয়েছেন। এমনকি কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে বিক্ষোভ করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। সে হুঁশিয়ারির বাস্তবায়নও করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি কলকাতার উপ-হাইকমিশন ঘেরাও করার সময় বিজেপির সদস্যরা পুলিশের ওপর হামলা পর্যন্ত করেছে। ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে কোনও পরিষেবা বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়ার হুঙ্কারও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে চিন্ময়কে বলা হয়েছে বাংলাদেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার নেতা নামে।

যে যার মতো যা করার তাই করে যাচ্ছে।এতো সব ঘটনার ব্যতিব্যস্ততার ফাঁকে সংস্কারসহ আসল কাজ হবে কীভাবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপে এবারের যাত্রায় তা ভুল হয়েছে। ধরে ধরে ইস্যু তৈরির এ নোংরা পথে যে যেদিক দিয়ে পারছে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। একটি বিশাল গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র মেরামত অনিবার্য কাজ। কোনটা মেরামত দরকার তা নাম ধরে ধরে বলার কোনও প্রয়োজন নেই! যেখানেই ত্রুটি সেখানেই মেরামত। সেই পথে পদে পদে বাধা। অথচ এটা জনগণের দাবি, সরকার সেটা মেনে নিচ্ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ড্রাইভাররা দেখিয়েছে আচ্ছা রকমের খেল। টক অব দ্য টাউন হয়েছে তারা।প্রেসক্লাব,শহীদ মিনার,আগারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনের লোকেদের সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে হিম্মত দেখিয়েছে। হামলে পড়ে সেনাবাহিনীকে উস্কানোর অপচেষ্টাও ছাড়েনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা সদস্যরা ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকার পরও মাঠে যারপরনাই সতর্ক অবস্থানে থাকতে হচ্ছে তাদের। সময়টা খারাপ তথা স্পর্শকাতর। ব্যারাকের দায়িত্বের পাশাপাশি বাইরের এসব জরুরি কাজে হিসাব কষে এগোতে হয়। পাহাড়ি জনপদে অশান্তি তৈরির হোতাদের রোখা সেনাবাহিনীর আরেক দায়িত্ব। এরই মধ্যে পাহাড়ি এলাকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে আবারো বেপরোয়া। পাহাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতার পেছনেও রাজনীতি ও কালোটাকার খেলা আছে। মাত্রাগতভাবে সমতলে আরো বেশি। এসব আন্দোলনে আওয়ামী লীগ-যুবলীগের কর্মীরা অনুপ্রবেশ করেছে। তারাই মূলত নানা অপকর্ম ও বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে। কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে বার্তা দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনই এখন সমাধান। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলে অর্ধেক সমস্যা কেটে যাবে, এমন কথাও বলছেন তারা। বাস্তবতাটা বড় কঠিন।

ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কার্যত হাসিনার অগিলগার্ক, আমলা, পুলিশ, গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। হাসিনাপন্থী কর্মকর্তাদের কয়েকজনকে বাদ দিলেও এখনো বেশির ভাগ কর্মকর্তা আওয়ামী অনুসারী। তারাও বসে নেই। একের পর এক বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরিতে বেশ ভূমিকা তাদের। তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক। তাদের কাছে এটি রাজনীতি-কূটনীতি। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকারীদের কাছে ষড়যন্ত্র। কিন্তু, মানুষ এখন আর ষড়যন্ত্র কথাটি শুনতে চায় না। তারা চায় সমাধান, ষড়যত্রের মূল উৎপাটন। এ কাজে ফ্রন্টলাইনে ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষার্থীরা, যাদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে ৫ আগস্ট। দুঃখজনকভাবে সেখানেও বিপত্তি। তরুণদের ব্যবহার-অপব্যবহার দুটোই বাড়ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পাঞ্চলে নাশকতার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সর্বত্র গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ছাত্র-জনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে রয়েছে। ভারতীয় হেজিমনি তৎপরতা সম্পর্কে বিশ্বসম্প্রদায়ও অবহিত রয়েছে। বন্ধুপ্রতিম দেশ মালয়েশিয়ার উন্নয়নের রূপকার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সব ধরনের বিভক্তি এড়িয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। পতিত স্বৈরাচারের দোসর এবং ভারতীয় অপপ্রচার, উস্কানি, সহিংসতা মোকাবেলা করে দেশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা মুখোশধারি ব্যক্তিরা যেন ভ্রান্ত ন্যারেটিভ সৃষ্টি করে ছাত্র-জনতার ঐক্যে ফাঁটল সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

 

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য।


আমার বার্তা/রায়হান আহমেদ তপাদার/এমই