গুগলকে ব্যবসার ধরন বদলানের নির্দেশ দিয়েছে আদালত

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

অনলাইন সার্চ ইঞ্জিন গুগলকে তার ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি করতে হবে না। তবে যেটা করতে হবে সেটা হলো, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে তথ্য ভাগ করে নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এক ফেডারেল বিচারক এমন আদেশ দিয়েছেন।

মার্কিন বিচার বিভাগ চাইছিল, গুগল যেন ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি করে দেয়। তবে রায়ে আদালত বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্রোম ব্রাউজার নিজেদের মালিকানায় রাখতে পারবে, কিন্তু একচেটিয়া চুক্তি আর করতে পারবে না। এর পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সার্চ-সংক্রান্ত তথ্য ভাগ করে নিতে হবে।

ইন্টারনেটের জগতে আরও অনেক সার্চ ইঞ্জিন বা ওয়েব ব্রাউজার থাকলেও বিশ্বব্যাপী মানুষ গুগল ছাড়া অন্যগুলো তেমন একটা ব্যবহার করে না বললেই চলে। ফলে ইন্টারনেটের জগতে সার্চ ইঞ্জিন বা ওয়েব ব্রাউজার হিসেবে কিছু খোঁজার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে গুগল। সে জন্যই গুগলে কিছু খোঁজাকে অনেকেই বলেন, গুগল করা। ইংরেজি অভিধানেও অবশ্য গুগল শব্দটিকে ক্রিয়াপদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সে কারণে মানুষের ধারণা, অ্যালফাবেটের সার্চ ইঞ্জিন গুগল একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। গুগল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যালফাবেটের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

গত বছরের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত এক রুলিংয়ে বলেন, গুগল কার্যত আইনসিদ্ধ একচেটিয়া কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে এবং ইন্টারনেটের জগতে তাদের যে প্রাধান্য রয়েছে, সেটা ব্যবহার করে তারা প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন ধারণা করা হচ্ছিল, গুগল ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু গত মঙ্গলবার আদালতের দেওয়া রায়ে গুগল একরকম বেঁচে গেছে।

গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের বাজার মূলত এখন ২ দশমিক ৫৬ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এই আয়ের বড় অংশ আসে সার্চ ইঞ্জিন থেকে। চলতি বছর সার্চ অপারেশন থেকে গুগল প্রায় ২০০ বিলিয়ন বা ২০ হাজার কোটি ডলার আয় করতে পারে বলে ধারণা। এর মধ্যে কয়েক শ কোটি ডলার অংশীদারদের পকেটে যাবে। ফলে মামলায় জড়িত বড় করপোরেট সবার জন্যই বিষয়টি লাভজনক হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

মামলার বিষয়

মামলার মূল বিষয় ছিল, গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ও ক্রোমের মতো পণ্য অ্যাপলের মতো কোম্পানির ডিভাইসে ডিফল্ট বা স্বয়ংক্রিয় সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে গুগল একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে গুগল ফুলেফেঁপে উঠছে, কিন্তু অন্য কোম্পানিগুলো মার খাচ্ছে।

গুগল জানিয়েছিল, এতটা কঠোর পদক্ষেপ না নিয়েও সমাধান সম্ভব। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাব ছিল, অ্যাপলসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির চুক্তি রয়েছে, সেখানে সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। এসব চুক্তির মাধ্যমেই গুগলের সার্চ ইঞ্জিন বিভিন্ন ডিভাইস ও ব্রাউজারে স্বয়ংক্রিয় হিসেবে থাকে।

এদিকে আদালতের রায়ের পর গুগল বিষয়টিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখেছে। তাদের দাবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির উত্থান এই রায়ে ভূমিকা রেখেছে।

বিবৃতিতে গুগল বলেছে, আদালতের সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়, এআইয়ের কারণে ডিজিটাল শিল্পে পরিবর্তন এসেছে, এআই মানুষকে তথ্য খোঁজার আরও অনেক উপায়ের সন্ধান দিয়েছে। তারা আরও জানায়, গুগল ২০২০ সালে মামলার পর থেকে যা বলে আসছে, তা-ই প্রমাণিত হলো, অর্থাৎ প্রতিযোগিতা এখন তীব্র। মানুষ সহজেই নিজেদের পছন্দের সেবা বেছে নিতে পারে।

গুগল শুরু থেকেই একচেটিয়াত্বের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তাদের দাবি ছিল, গুগলের সার্চ ইঞ্জিন অন্যদের চেয়ে ভালো। মানুষ স্বাভাবিকভাবে ভালোটাই বেছে নেয়।

গত বছর বিচারক মেহতা রায় দেন যে গুগল অনলাইন সার্চ–বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেটা ধরে রাখতে অন্যায্য পন্থা অবলম্বন করছে। সেটা করতে গিয়ে তারা মার্কিন আইন ভেঙেছে। তিনি আরও বলেন, ক্রোম বিক্রিতে বাধ্য করা এ মামলার সঙ্গে মানানসই নয়। একই সঙ্গে গুগলকে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমও বিক্রি করতে হবে না, যে অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে বিশ্বের বেশির ভাগ স্মার্টফোন চলে।

গুগল যুক্তি দিয়েছিল, অ্যান্ড্রয়েডের মতো অপারেটিং সিস্টেম বিক্রি করে দিলে গুগল ঠিকভাবে কাজ করবে না বা অকেজো হয়ে যাবে।

রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাবিগেইল স্লেটার লেখেন, আদালতের নির্দেশে প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। তবে আদেশটি লক্ষ্য পূরণে যথেষ্ট কি না, তা বিবেচনা করা হচ্ছে।

রায়ের পর গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের শেয়ারের দাম ৮ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। অ্যাপল, স্যামসাং ও মটোরোলার মতো স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোও এতে সুবিধা পাবে।

কী করত গুগল

বিষয়টি হলো, ফোন বা ডিজিটাল যন্ত্রে নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন ও ব্রাউজার আগে থেকে যুক্ত করতে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো কোম্পানিকে গুগল প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার দিত। আদালত জানায়, ২০২১ সালে শুধু অ্যাপল, মজিলা ও অন্যদের সঙ্গে এমন চুক্তির জন্য গুগল ২৬ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার দিয়েছে।

এখন থেকে গুগল সার্চ, ক্রোম, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা জেমিনি অ্যাপের জন্য একচেটিয়া চুক্তি করতে পারবে না। ফলে ফোন কোম্পানিগুলো চাইলে অন্য সার্চ ইঞ্জিন, ব্রাউজার বা এআই অ্যাসিস্ট্যান্টও আগে থেকে ইনস্টল করে দিতে পারেব। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য গুগল এখনো অর্থ দিতে পারবে।

ডিপওয়াটার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের জিন মুনস্টার বলেন, এই রায় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য সুখবর। তিনি বলেন, এই রায়ে অ্যাপলও জিতেছে। কেননা, এখন গুগলকে প্রতিবছর নতুন করে চুক্তি করতে হবে।

তবে গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বী ডাকডাকগো বলেছে, এই রায়ে গুগলের অবৈধ আচরণ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আসবে না। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও গ্যাব্রিয়েল ওয়েইনবার্গ বলেন, ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে ধারা ছিল, তা অব্যাহত থাকবে।

গুগল ভাঙলে কী হতো

গুগলকে ভেঙে দেওয়া হলে বা ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি হলে ডিজিটাল জগতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারত। বিজ্ঞাপন খাতে প্রতিযোগিতা বাড়লে ব্যয় কমত। এতে ছোট ও নতুন কোম্পানির বাজারে প্রবেশ সহজ হতো। একইভাবে অ্যাপের জগতে গুগল প্লে স্টোরের একচেটিয়া প্রভাব ভাঙলে নতুন অ্যাপ ও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। এতে গ্রাহকদের হাতে আসবে আরও বিকল্প। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা মনে করেন, গুগল এখন স্টার্টআপগুলোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে; তাই তাকে ভেঙে দিলে শিল্পে গতি আসবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে ইন্টারনেট খাতের অবদান বৈশ্বিক জিডিপির ১০ থেকে ২০ শতাংশে উঠতে পারে; গুগল ভাঙা সেই প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হতে পারে।

কিন্তু গত মঙ্গলবার আদালতের রায়ের পর আপাতত সে রকম কিছু ঘটছে না। এ রায়ের মধ্য দিয়ে যে গুগলের আইনি লড়াই শেষ হয়ে যাবে, তা–ও নয়। চলতি মাসের শেষের দিকে গুগলকে আরও একটি মামলায় বিচার কার্যক্রমে যেতে হবে। এটি বিচার বিভাগের পৃথক আরেকটি মামলা, যেখানে বিচারক মন্তব্য করেছেন যে গুগল অনলাইন বিজ্ঞাপন প্রযুক্তিতে অবৈধভাবে একচেটিয়াত্ব ধরে রেখেছে।

আমার বার্তা/এল/এমই