ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি, ফিরছেন ভিসা বাতিল হওয়া নাগরিকেরা

প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৪২ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন:

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। 

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর এ গোলাগুলি হয়। এই পরিস্থিতিতে পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশী দুই দেশকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

এদিকে পাল্টাপাল্টি ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্তের পর ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকেরা নিজ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। দুই দেশই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে ভারত। এ ঘটনায় পাকিস্তানকে জড়িয়ে ভারতের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে গতকাল শুক্রবার পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতকে সতর্কও করেছে পাকিস্তান। 
এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ সব সময়ই উদ্বেগের। যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়, তাহলে এই সংঘাত একটি করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

পেহেলগামে হামলার পর নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখতে গতকাল কাশ্মীর গেছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি তিনি হামলার স্থলও পরিদর্শন করেন। আগের দিন সর্বদলীয় বৈঠকে কাশ্মীরে নিরাপত্তাব্যবস্থায় যথেষ্ট গাফিলতি ছিল বলে স্বীকার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।

গত মঙ্গলবার বিকেলে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বৈসারণ উপত্যকায় বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামে স্বল্প পরিচিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী।

এই হামলায় পাকিস্তানের মদদ আছে অভিযোগ তুলে গত বুধবার প্রতিবেশী দেশটির নাগরিকদের ভিসা বাতিল ও সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নেয় ভারত। জবাবে পরদিন ভারতের নাগরিকদের ভিসা বাতিল, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিত, আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নেয় পাকিস্তান।

পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে অব্যাহত উত্তেজনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। ভারতের সেনাবাহিনীর সূত্রগুলো দাবি করেছে, পাকিস্তানের সেনারা প্রথম গুলি করেছেন। পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কর্মকর্তা সৈয়দ আশফাক গিলানি গোলাগুলির খবর নিশ্চিত করেছেন। তবে কোন পক্ষ আগে গুলি চালিয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।

নিয়ন্ত্রণরেখার ঠিক কোন এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে পৃথক গোলাগুলির ঘটনায় বান্দিপোরায় দুই ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পর্যটকদের ওপর হামলাকারী দুই সন্দেহভাজনের বাড়ি গতকাল সকালে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন ভারতীয় সেনারা।

এর আগে তিন সন্দেহভাজনের বিষয়ে তথ্য চেয়ে স্কেচসংবলিত পোস্টার ছাপিয়েছে ভারতের পুলিশ। তাঁরা হলেন ভারতের নাগরিক আদিল হোসেন, পাকিস্তানের নাগরিক আলী ভাই ও হাশিম মুসা। এ ছাড়া ভারতের আরেক নাগরিক আসিফ শেখকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ভারতের দুই নাগরিকের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে দুই দেশের নাগরিকদের নিজ নিজ দেশে ফিরতে দেখা যায়। ওয়াঘা সীমান্তের ভারতের অংশ দেখা যায়, দেশটির নাগরিকেরা দেশে ফিরছেন। সীমান্তে স্বজনদের বিদায় দিতে এসেছেন কেউ কেউ। সীমান্তের পাকিস্তান অংশে দেখা যায়, এক নারীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁর স্বজনেরা। ভিসা বাতিল হওয়ায় ওই নারীর স্বামী ভারতের নাগরিক দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

এদিকে বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠকে কাশ্মীরে নিরাপত্তাব্যবস্থায় যথেষ্ট গাফিলতি ছিল বলে স্বীকার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এমন গাফিলতি ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকবে ভারত। এই হামলার মদদদাতা দাবি করে পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেওয়া হবে বলেও বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা ও গাফিলতির বিষয়ে কয়েকজন নেতা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এত বড় একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে, অথচ গোয়েন্দারা তা টের পেলেন না! ঘটনাস্থলে একজন নিরাপত্তারক্ষীও কেন ছিলেন না, সেই প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এর পেছনে ছিল এক গভীর চক্রান্ত। অথচ কেউ তা টের পেল না কেন? এই ব্যর্থতার দায় পুরোপুরি সরকারের।

সরকারের পক্ষে গাফিলতি ও ব্যর্থতা মেনে নিয়ে বলা হয়, প্রশাসনকে না জানিয়ে স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা ওই পথ খুলে দিয়েছিল। সন্ত্রাসীরা সেই সুযোগ নিয়েছে। সরকার জানায়, প্রতিবছর জুন মাসে অমরনাথযাত্রার আগে পেহেলগামের পথ পর্যটকদের জন্য খোলা হয়। কিন্তু এবার স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা ২০ এপ্রিল থেকেই সরকারের অজান্তে তা খুলে দেয়। ফলে প্রশাসন নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের সুযোগ পায়নি।

ওই বৈঠকে বিরোধী নেতারা শাসক দল বিজেপির হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের কড়া সমালোচনা করেন। কয়েকজন নেতা বলেন, হিন্দুত্ববাদীরা এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে ও দেখাতে চাইছে। বিজেপি নেতাদের কেউ কেউ খোলাখুলিভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে চলেছেন।

হামলার পর পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসা বাতিল ও তাঁদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গতকাল মুখ্যমন্ত্রীদের ফোন করে তিনি বলেছেন, ভিসা বাতিলের পর পাকিস্তানিদের শনাক্ত করে যেন দ্রুত ফেরত পাঠানো হয়।

যুক্তরাজ্যের স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরে হামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। এ বিষয়ে বিশ্বকে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ‘যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত’ বলে মন্তব্য করেন খাজা আসিফ। তিনি বলেন, ‘ভারত যে ধরনের পদক্ষেপ নেবে, সেটা পর্যালোচনা করে আমরা পদক্ষেপ নেব। আমরা ভেবেচিন্তে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেব।’ খাজা আসিফ বলেন, যদি সর্বাত্মক হামলা চালানো হয় বা এ ধরনের কিছু হয়, তখন নিশ্চিতভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে।

এমন পরিস্থিতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত কি না—এমন প্রশ্নে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পেহেলগামের হামলার সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়ানোর ভারতীয় চেষ্টার নিন্দা জানিয়ে দেশটির সিনেটে পাস করা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের মর্যাদাহানি করতে ভারত সরকার পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। 

অপপ্রচারের এই ধরন পরিচিত। সংকীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যই সন্ত্রাসবাদের ঘটনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রস্তাবে বেআইনি ও একতরফাভাবে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তেরও নিন্দা জানানো হয়। এতে বলা হয়, এমন পদক্ষেপ এই চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা যুদ্ধের উসকানির শামিল।

এর আগে পেহেলগামের হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানান পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসহাক বলেন, ‘যদি পেহেলগামের ঘটনায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ থাকে, তবে দয়া করে তা আমাদের এবং পুরো বিশ্বকে দেখান।’

সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত নিয়ে ভারতের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। তিনি বলেন, সিন্ধু নদ পাকিস্তানের জনগণের এবং পাকিস্তানের পানির অধিকার হরণ করার যেকোনো চেষ্টার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।

সিন্ধু প্রদেশের সুক্কুর শহরে গতকাল এক সমাবেশে পিপিপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিন্ধু নদ আমাদের এবং এটি আমাদেরই থাকবে।’এর আগে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী সি আর পাতিল বলেন, সিন্ধু পানিচুক্তির অধীনে যাতে এক ফোঁটা পানিও পাকিস্তানে না যায়, তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করছে ভারত।


কাশ্মীরে হামলার পর পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তৈরি হওয়া উত্তেজনার মধ্যে দেশ দুটিকে ‘সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের’ আহ্বান জানান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আন্তোনিও গুতেরেসের এ বার্তা সাংবাদিকদের জানান।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি বেশ কিছু পদক্ষেপের ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপের দিকে না যায়, সে জন্য দেশ দুটিকে তিনি সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান ডুজারিক।

জাতিসংঘ মহাসচিব আরও বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যেকোনো সমস্যা অর্থবহ আলোচনা ও পারস্পরিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি এবং এটাই হওয়া উচিত।’

২০১৯ সালে কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪১ জন সেনা নিহত হন। ওই হামলার পর পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। এবারের হামলার পরও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির কয়েকজন নেতা।

 

আমার বার্তা/এল/এমই