একীভূত হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত পাঁচ ব্যাংক
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৫০ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

দেশের সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অর্থ উপদেষ্টার অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনেকটা হাতে হাতেই করিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত ২৪ আগস্ট তিনি লম্বা সফরে জাপান যান। তার আগে দুইদিন ছিল সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি। এ কারণে গত সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে অর্থ উপদেষ্টার সম্মতি নেওয়া হয় বলে একটি সূত্র জানায়।
জানা গেছে, দুর্বল ৫ ব্যাংক একীভূত করার পর যে ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। একটি ভালো অবস্থানে যাওয়ার জন্য ব্যাংকটিকে সক্ষম এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আর এজন্য প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণসহ সামগ্রিক শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং সেক্টর রিফর্ম টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তারল্য সংকটে উপনীত ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে লিপ্ত ১৫টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়।
তফসিলি ব্যাংকসমূহের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিরূপণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত এবং ব্যাংকসমূহ হতে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে সংকটাপন্ন ছয়টি তফসিলি ব্যাংকের (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, এক্সিম ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লি.) সম্পদের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য খ্যাতিসম্পন্ন দুটি আন্তর্জাতিক কনসালটিং ফার্ম কেপিএমজি (শ্রীলঙ্কা) এবং ইওয়াই (শ্রীলঙ্কা)-কে নিয়োগ দেওয়া হয়।
একই সময়ে এ সংকটের নেপথ্যে তথা বিপুল পরিমাণের শ্রেণিকৃত বিনিয়োগ বা ঋণ ও অগ্রিমের পেছনের মূল কারণসমূহ উদ্ঘাটনে এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রমও পরিচালনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক কনসাল্টিং ফার্মের মূল্যায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত হতে এটা পর্যবেক্ষিত হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা সত্ত্বেও ছয়টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি ঘটেনি; বরং এসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক হতে সরাসরি গৃহীত জরুরি তারল্য সহায়তা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টির বিপরীতে অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক থেকে গৃহীত নগদ সহায়তার অর্থ যথাসময়ে পরিশোধ করতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর-ভিত্তিক অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ অনুযায়ী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ১২ হাজার ১২৪ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসির ২৩ হাজার ৮১১ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক পিএলসির ২০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ২৪ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের এক হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা।
একই তারিখে এসব ব্যাংকের খেলাপি বিনিয়োগ বা ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬০ হাজার ৬৯ কোটি, ১৩ হাজার ৫৭০ কোটি, ২৭ হাজার ৪১৬ কোটি, ২৫ হাজার ১০১ কোটি, ২৫ হাজার ৩৯২ কোটি এবং ৬৭৮ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ বা ঋণের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৯৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৯৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ৯৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ, ৬৭ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ৯০ দশমিক ২৬ শতাংশ।
২০২৫ সালের ৩০ জুন এসব ব্যাংকের তারল্য সহায়তার মোট স্থিতি ছিল যথাক্রমে ১৫ হাজার ২৫৯ কোটি, দুই হাজার ৮৬৫ কোটি, পাঁচ হাজার ২৫৩ কোটি, নয় হাজার ৫৫০ কোটি এবং ১০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডকে ২০২৫ সালের মে মাসে ১০০ কোটি টাকার তারল্য সুবিধা দেওয়া হয়। এসব ব্যাংককে বিগত এক বৎসরেরও বেশি সময়ে বিভিন্ন তারিখে তারল্য সহায়তা দেওয়া হলেও তাদের আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি; বরং তাদের তারল্য সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এসব ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি, শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ বা ঋণ ও অগ্রিমের হার, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্য সংকট এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তারা আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারদের প্রদেয় পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। এর ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট হুমকিস্বরূপ।
চিঠিতে বলা হয়েছে, যেহেতু এসব ব্যাংক আর কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে যে, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য টেকসই ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রণীত ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর আলোকে ব্যাংকিং খাতের এ সব সংকটাপন্ন ব্যাংককে অতিসত্ত্বর রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা আবশ্যক।
গভর্নর বলেন, সরকার সম্মত হলে এ উদ্দেশ্যে প্রাথমিকভাবে একটি নতুন ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটির মূলধন সংস্থানের জন্য সাময়িকভাবে সরকারের আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর আলোকে রেজল্যুশনের অধীন তফসিলি ব্যাংকসমূহ ‘হস্তান্তরকারী ব্যাংক’ এবং সরকারের স্থাপিতব্য নতুন ব্যাংকটি ‘হস্তান্তরগ্রহীতা ব্যাংক’ হিসেবে গণ্য হবে।
প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক ও পেশাদারত্বের ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। পরে ব্যাংকটির মালিকানা (শেয়ার) দেশি-বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে স্থানান্তরের মাধ্যমে সরকারের সমুদয় আর্থিক সহায়তা মুনাফাসহ ফেরতযোগ্য হবে।
সম্পদের গুণগত মান যাচাইকারী ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির শেয়ার মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকায় এ মুহূর্তে ব্যাংকটিকে রেজল্যুশনের আওতাভুক্ত রাখা বাঞ্ছনীয় নয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে।
এক্ষেত্রে হস্তান্তরগ্রহীতা ব্যাংক হিসেবে নতুন একটি ব্যাংক স্থাপনের প্রয়োজন হবে। এ ব্যাংকের সঙ্গে হস্তান্তরকারী পাঁচটি ব্যাংক তাদের সমুদয় সম্পদ ও দায়সহ একীভূত হবে। হস্তান্তরকারী ব্যাংকসমূহের বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি, মন্দ সম্পদ ও তারল্য সংকট থাকায় এ ঝুঁকি হস্তান্তরগ্রহীতা ব্যাংককে বহন করতে হবে।
এই ঝুঁকি লাঘব করে সফলভাবে রেজল্যুশন প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য কত পরিমাণ তরল সম্পদ প্রয়োজন হবে তা নিরূপণে ব্যাংক রেজল্যুশন ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে নানাভাবে সিমুলেশন এক্সারসাইজ সম্পাদন করা হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটির মূলধন সংস্থানের জন্য পরিশোধিত মূলধন হিসেবে আনুমানিক ৩৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকার আমানত মূলধনে রূপান্তর করা হবে এবং অবশিষ্ট ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন যোগানের বিষয়টি সরকার ব্যবস্থা নেবে।
প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। পরে ব্যাংকটির মালিকানা (শেয়ার) দেশি-বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে স্থানান্তর এবং নতুন আইপিও ইস্যুর মাধ্যমে সরকারের সমুদয় আর্থিক সহায়তা মুনাফাসহ ফেরতযোগ্য হবে।
তবে রেজল্যুশন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন ব্যাংকটিকে বিবিধ নীতি সহায়তা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে, সরকারের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে ন্যূনতম পাঁচ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হলে তা ব্যাংকটির আর্থিক সূচকাবলী উত্তরণে যথেষ্ট সহায়ক হবে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চা অনুযায়ী প্রভিশন-পরবর্তী মুনাফার ওপর কর আরোপের বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থ উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ জানান।
আমার বার্তা/এল/এমই