আইসিএবির প্রতিক্রিয়া
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ১৯:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সে লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে বলে জানিয়েছে ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।
বুধবার (৪ জুন) রাজধানীর কারওয়ানবাজারস্থ সিএ ভবনে আয়োজত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিমত জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার বলেন, নতুন অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত বছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৪১ লাখ কোটি টাকা। এটি চলতি বছরের চেয়ে ৪.২৫ শতাংশ বেশি। দেশের বিদ্যমান কর কাঠামো ও কর আদায় প্রক্রিয়ায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে ।
তবে কর কাঠামো ও কর আদায় প্রক্রিয়ায় আধুনিকরণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌছা অসম্ভব কিছু নয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী বছর থেকে সব করদাতার অনলাইনে বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা হচ্ছে। আমরা মনে করি অনলাইনে রিটার্ন জমা করদাতাদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সব করদাতার অনলাইনে বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা নিশ্চিত করা গেলে রিটার্ন জমাকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।’
অর্থ উপদেষ্টা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার একটি সময়োপযোগী ও ব্যাপক আকারের বাজেট পেশ করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেট আমাদের জিডিপির ১২.৭ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে চলে আসা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জুলাই-আগস্ট বিপ্লব, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকার ২ লাখ ৩০ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে যা আমাদেরকে একটি উন্নত দেশে পৌছার যাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমার ধন্যবাদ জানাতে চাই এ কারণে যে, এই প্রথম বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় বাজেটের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দেশের নারীদের অবৈতনিক ও অস্বীকৃত সেবা এবং গৃহস্থালির কাজের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সরকার দেশের জিডিপি গণনায় এই প্রথমবারের মত নারীর অবৈতনিক শ্রমের অর্থনৈতিক মূল্য অর্ন্তভূক্ত করার পরিকল্পনা করছে—যা একটি বড় নীতিগত পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমি মনে করি। আমরা এই যুগান্তকারী পদক্ষেপের জন্য সরকারকে আবারও অভিনন্দন ও সাধুবাদ জানাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি যে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার পূর্বের বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে, যা ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংগ্রাম মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত সংকোচনমূলক পদ্ধতির প্রতিফলন। গত অর্থবছরের বাজেটে মূল বরাদ্দের তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৩.২ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং বিদেশী ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং সীমিত রাজস্ব স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কম বাজেট ঘাটতি নির্ধারণ করা একটি বুদ্ধিমানের পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।
তিনি বলেন, দেশে ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির চাপের পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন বাজেটে ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৭৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে—কিন্তু ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে। এই কর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য খুব বেশি স্বস্তিদায়ক হবে না।
এ ছাড়া প্রান্তিক করদাতাদের ন্যূনতম কর ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করা হলে প্রান্তিক করদাতাদের ওপর করের বোঝা বাড়বে। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষের জন্য ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই সীমা সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো গেলে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর কিছুটা উপকার হতো। সরকারের উচিত কর জাল সম্প্রসারণ এবং কর ফাঁকি রোধ করে কর আদায়ের চেষ্টা করা। কর ব্যবস্থাকে আরও প্রগতিশীল এবং ন্যায়সঙ্গত করার জন্য সংস্কারও গ্রহণ করা প্রয়োজন।
কোম্পানির লেনদেনের ওপর কর বা টার্নওভার কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম কর (মিনিমাম ট্যাক্স) করনীতির পরিপন্থী। ব্যবসায়ে লাভ হলেই শুধু করযোগ্য আয়ের ওপর কর আরোপ করা উচিত হবে বলে আমরা মনে করি। তাই এটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত কিছু কর নীতি চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেমন ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমাতে বেশ কয়েকটি পণ্যের উপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার বা হ্রাস করা এবং অন্যান্য পণ্যের উপর শুল্ক কমানো। এই কর প্রস্তাবগুলির লক্ষ্য বাজার অ্যাক্সেস এবং বাণিজ্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা। বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে, ২০২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যমান কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে যেমন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগের বাধা মোকাবেলা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষায় উচ্চতর বিনিয়োগ এসবের দিকে সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
আমার বার্তা/এমই