বিদ্যুৎ খাতে ওরিয়নের আগ্রাসন, ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ
অনলাইন ডেস্ক
দেশে গত সাড়ে ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে মহালুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এতে ওরিয়ন গ্রুপের আগ্রাসন ছিল ভয়াবহ। গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম বিগত সরকারের উচ্চ পর্যায়ে লবিং করে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। প্রভাবশালীদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে বিনা টেন্ডারে বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প বাগিয়েছেন।
চুক্তির শর্ত অনুসারে ৩ বছরের মেয়াদে প্রকল্পের দায়িত্ব পেলেও পরবর্তী সময়ে সেই মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে নিয়েছেন। মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ওবায়দুল করিম হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অস্তিত্বহীন কোম্পানিও রয়েছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কিছুদিন আগে তড়িঘড়ি করে অন্তত সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন ওবায়দুল করিম। অস্তিত্বহীন কোম্পানিসহ ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ৩ ব্যাংক অগ্রণী, জনতা ও রূপালীর প্রস্তাবে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখানেই শেষ নয়! বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে ওরিয়নের ৭টি কোম্পানি দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের ৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযার্য়ী, গত সাড়ে ১৫ বছরে কোনো রকম দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই কোনো কাজে আসেনি। এর মধ্যে বেসরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনসংক্রান্ত ওরিয়ন গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে রাষ্ট্রের কাছ থেকে ৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা নিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেড, ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা লিমিটেড, ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা ইউনিট-২ লিমিটেড, ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেড এবং ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেড। এর মধ্যে ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা ইউনিট-২-এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
>> জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ:
বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকিং আইনের অন্তত দুটি বিধি লঙ্ঘন করে এবং একটিতে ব্যাংক কোম্পানি আইনকে পাশ কাটিয়ে অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের প্রস্তাবিত ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত হওয়ার পরও সিন্ডিকেট ফাইন্যান্সিং বা অর্থায়নের মাধ্যমে ওই ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে একক গ্রাহকের ঋণসীমা লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের বিধি ভঙ্গ করে শুধু ওরিয়নের ক্ষেত্রে (বিদ্যুৎ খাত) শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর মধ্যে সমস্যাজর্জরিত জনতা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা-২ লিমিটেডের (ওপিডিএল-২) নামে কক্সবাজারের মহেশখালীতে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এই ঋণ অনুমোদন করা হয়। অবশ্য ইতোমধ্যে এই ঋণ বিতরণ নিয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যাংকে তারল্য-সংকটের কারণে এ ঋণ বিতরণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
>> ঋণের ৪ হাজার কোটি টাকা পাচার:
নবায়নযোগ্য সোলার পাওয়ার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি এনারগন টেকনোলজি অ্যান্ড ফার্স্ট জেন এনার্জি এবং চায়না সানার্জি কোম্পানির নামে ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা ঋণ নেন ওবায়দুল করিম। এই ঋণের খেলাপি টাকার পরিমাণ অন্তত ৫০০ কোটি। এই কোম্পানিতে ওবায়দুল করিমের পার্টনার তার ড্রাইভার খালেদ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ। ওরিয়ন পাওয়ার ঢাকা ইউনিট-২-এর নামে ঋণ নেওয়া হয় ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। এটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণও ৫০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে চায়না ফুসিয়ান এনার্জিসর ৬০ শতাংশ অংশীদারত্ব রয়েছে। এ ছাড়া ১০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে লক্ষ্যে ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের নামে ৮১১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এখানেও খেলাপির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা। কুইক রেন্টালের আওতায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেডের নামে ২৩৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের নামে ঋণ নেওয়া হয় ৬২৫ কোটি টাকা। ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের নামে ঋণ ১০২ কোটি টাকা এবং ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ঋণ নেওয়া হয় ৩৪০ কোটি টাকা। এভাবে বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে জানা গেছে।
>> প্রভাবশালীদের ঘাড়ে সওয়ার:
বিগত সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে কোনো রকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই গত ১৫ বছরে ৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন। শুরুতে ৩ বছর মেয়াদে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও দফায় দফায় এই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এভাবেই ১৫ বছর ধরে লুটপাট চালিয়েছেন ওরিয়নের ওবায়দুল করিম। একই কেন্দ্র সরকারের কাছে একাধিকবার বিক্রি করা হয়। এসব কেন্দ্রের মোট বিনিয়োগের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারীরা দেয়, বাকিটা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মেটানো হয়। ইকুই টি ইনভেস্টমেন্টের ওপর দেওয়া হয় মুনাফা (রিটার্ন অব ইকুইটি)। সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় শোধ করলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটা বেসরকারি কোম্পানিরই রয়ে যায়। পরে মেয়াদ বাড়ানো হলেও একই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে নির্মাণ ব্যয় পরিশোধ করা হয়। সেই ব্যয় আগের চেয়ে কিছুটা কম হয়। এভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে দেশে লুটপাট হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
এসব অপকর্মে সহযোগী হিসেবে ওবায়দুল করিম বেছে নিয়েছেন বিগত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। এর মধ্যে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছেন তৎকালীন সরকরের প্রভাবশালী মন্ত্রী মির্জা আজমকে। তাকে ৪০ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে ওবায়দুল করিমের শেয়ার ৬০ শতাংশ।
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবসায়িক পার্টনার করা হয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। তাকে ৩০ শতাংশ ছেড়ে দিয়ে ৭০ শতাংশ নিজে রেখেছেন ওবায়দুল করিম।
ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের ৪ শতাংশ শেয়ার নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে এবং ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ সাবেক মন্ত্রী মির্জা আজমকে দিয়ে ব্যবসায়িক পার্টনার বানানো হয়েছে। বাকি ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার নিজে রেখেছেন।
এ ছাড়া ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার দিয়ে মির্জা আজমকে পার্টনার বানিয়েছেন ওবায়দুল করিম। -- সূত্র : খবরের কাগজ
আমার বার্তা/জেএইচ